চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

স্মরণ : আবদুল ওয়াহাব বি এ বি এড

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৩০ মে, ২০১৯ | ২:১৬ পূর্বাহ্ণ

২০১২ইং তারিখ মোতাবেক হিজরী ১৪৩৩ সালের মাহে রমজানুল মোবারকের সমাপনী দশক যা কিনা নাজাতের দশক হিসেবে সুবিদিত, এর ২৪ তারিখ সকালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন উত্তর চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুণীজন বলে পরিচিত শিক্ষাবিদ সমাজসেবী ও সমাজ সংস্কারক আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব বি এ, বি এড। রাউজানের ইয়াছিন নগরে তার জন্ম এবং উক্ত এলাকা নিয়েই তার স্বপ্ন ও বহুবিধ অবদান । তিনি শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একটি মডেল প্রতিষ্ঠান। তাকে অনুসরণ করার মত অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য তিনি ধারণ করতেন। দুই দুইবার নির্বাচিত ১নং হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমির হাট ইয়াছিন শাহ পাবলিক স্কুল তাঁরই হাতে গড়া এবং দীর্ঘদিন এ প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের পদে থেকে সে অজপাড়া গাঁয়ে ঘরে ঘরে শিক্ষার মশাল জ্বালিয়েছেন।
১৯৯৫ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। এলাকায় তিনি ‘ওয়াহাব স্যার’ হিসেবে অত্যন্ত ভক্তির সাথে সুপরিচিত। এছাড়া তিনি আগ্রাবাদ বারিক মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, কুয়াইশ বুড়িশ্চর উচ্চ বিদ্যালয় ও নাঙ্গলমোড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। হযরত ইয়াছিন শাহ স্কুলের পাশে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন তার এক স্বপ্নের গুলি¯ঁÍা ‘হযরত ইয়াছিন শাহ পাবলিক কলেজ’। সবুজে ঘেরা গ্রামে এ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি নীতি নৈতিকতা আদর্শ বৈশিষ্ট ও ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্বীবিত। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তিনি চালচলন বেশভূষায় ছিলেন একজন নিরহঙ্কার ধর্মীয় সাধক। বার্ধক্য জীবনের বেশিরভাগ সময়েও তিনি ইংরেজি বাংলা পত্রপত্রিকা ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ে সময় কাটাতেন। এ সময়ও তার শখ ছিল বই কেনা বই পড়া। তিনি কুরআন শরীফের বেশ কিছু সূরা ও আয়াত অর্থ মর্মসহ ব্যাখ্যা করতেন যা একজন উঁচু মানের আলিমের পক্ষেও সম্ভব নয়।
তাঁর চিন্তার বিশালত্ব ছিল অনন্য সাধারণ। তিনি বলতেন ধর্ম মানে যা ধারন করা হয়। ইসলাম ধর্ম নিত্যদিন সর্বক্ষেত্রে ধারণ করার মত একটি মতাদর্শ। এটি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মতও। ইসলামের এসব অনুশাসন মেনে চললে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, ছাত্রজীবন, ছাত্রীজীবন ও পেশাগত জীবন সর্বত্র উপকার। এ বিষয়টি আধুনিকতার খেলাপও নয়। আর পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রগতির জীবনধারা। শুধু পরকালীন বিষয়, জান্নাতের কথা ও জাহান্নামের ভয় আমরা ওয়াজ কালামে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। অথচ এর বাইরে এবং এর আগে আমাদের আরও অনেক আকার্ষণীয় প্রাপ্তি রয়েছে। যা পরকালীন অনন্ত সুখশান্তি ও পুরস্কারের পূর্বশর্তও বটে। সেসব মূল্যবান আয়াত, হাদীস ও কথামালাগুলো আমরা সাধারণ মানুষকে ব্যাখ্যা করে তাদের অনুসরণের জন্য উৎসাহিত করে তুলিনা বা তুলতে জানিনা। যার কারণে মানুষ আমলের দিকে ও চিন্তার দিকে পিছিয়ে রয়েছে। এটি ধর্ম প্রচারকদের খন্ডিত চিন্তা এবং ব্যর্থতাই বটে।
তিনি বলতেন, আসুন আমরা আল্লাহর শাস্তি ও ভয় প্রদর্শনের সাথে সাথে তার পক্ষ থেকে পুরস্কার ও নাযাতের সুসংবাদ দিয়ে মানুষকে ডাকি। এতে ইসলামী প্রচার প্রসার সহজতর হবে। আসলে আমাদের নবীজীও (স) তাই বলেছেন: বাশশিরু ওয়ালা তুনাফফিরু; ইয়াসসিরু ওয়ালা তুআসসিরুÑ তোমরা মানুষদেরকে সুসংবাদ দাও বেশি, ভয়ের বিষয়াদি নয়। ইসলামকে সহজভাবে বুঝাও, কঠিনভাবে নয়।’(আল হাদীস)। এ মনীষী পুরুষ বলতেন, ইসলামের প্রথম কথা রাব্বানা আ’তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাহ, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাহ, ওয়াক্বিনা আযাবান নাÑর।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে সর্বপ্রথম এই দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণ ও সৌভাগ্য দিয়ে ভরপুর করে দাও এবং আখিরাতের সমুদয় কল্যাণও আমাদের নসিব কর আর পানাহ দাও জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে।’ সুতরাং ইসলামী অনুশাসন মেনে চললে একজন মানুষ সর্বপ্রথম প্রতিদিনের জন্য নিষ্পাপ ও নিষ্ঠাময় আদর্শ জীবন পরিচালিত করতে পারেন।
আমি তার সন্তানতুল্য। তার গড়া কলেজের একজন শিক্ষক। একজন ধর্র্র্র্মীয় লেখক ও আলিম হওয়ার কারণে তিনি আমাকে প্রচুর ¯েœহ করতেন এবং নানা বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। তিনি চাইতেন পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আমল সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। একইসাথে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও তাদের ধর্মকর্ম ও মহাপুরুষদের বাণীমতে জীবন পরিচালিত করুক। প্রত্যেক মহাপুরুষের সাধনা ছিল মানুষকে সৎ ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হওয়ার দীক্ষা দেওয়া। পীর আউলিয়া দরবেশকে তিনি খুব ভালবাসতেন। আজীবন তিনি মাইজাভান্ডার শরীফের ত্বরিকার খিদমত করে গেছেন। ইয়াছিন নগর যে মহান দরবেশের নাম ও পুণ্যস্মৃতি বহন করে তাঁর মাজারটিও তিনি দায়িত্ব মনে করে দেখাশুনা করতেন।
প্রায় সময় লাঠি ভর করে ছুটে আসতেন তিনি নিজের গড়া কলেজে। শিক্ষক শিক্ষিকাদের পোশাক-আশাকে শালীন হওয়ার তাগিদ দিতেন। একইভাবে ছাত্রছাত্রীদেরকেও শালীন চলাফেরার জন্য শাসন করতেন। এলাকাবাসী এ গুণীজনকে হারিয়ে খুবই শোকাহত। কারণ, তিনি শুধু ছাত্রছাত্রীদের কাছে নয়, এলাকাবাসী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নারী-পুরুষের জন্য ছিলেন দরদী মুরুব্বি। তিনি নিজেও স্বাবলম্বী পরিবারের উত্তরাধিকার বহন করতেন তাঁর সন্তানরাও আজ শিক্ষাদীক্ষা ও নানা ব্যবসা বাণিজ্যে সুনামের সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত। এ সুবাদে তার গ্রামের বাড়ি ছিল প্রায় সময় সর্বসাধারণের মেজবান ও আপ্যায়নস্থল।
মরহুম আবদুল ওয়াহাব (রহ.) ছিলেন একজন মনীষাচরিত, দয়ালু মনের একজন সুযোগ্য আদর্শ পুরুষ। একজন আলিম লেখক হিসেবে আমি নিজে খুব অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে অতীত ও বর্তমান মনীষীদের জানতে সময় দান করি। মরহুম আবদুল ওহহাব বি এ বি এডকে সত্যিকার অর্থে আমি একজন বহুমুখী প্রতিভার সমাজ ও ইসলামের ক্ষণজন্মা চিন্তাশীল মনীষী হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি। শিক্ষকসুলভ আচরণে তার দৃষ্টান্ত ছিল অদ্বিতীয়। তিনি যে কোন পুরনো কথাকে নতুন করে রস ও যুক্তি দিয়ে শ্রোতার সামনে তুলে ধরতে পারতেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন মনের কথাগুলো একটি সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে সাধারণের মাঝে তুলে ধরতে আর হাক্কানী ও কর্মঠ আলিম যুবকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়তে। আর, কর্মময় বিজ্ঞানময় ও আধুনিক ইসলামকে ব্যাখ্যা করে কুরআন ও হাদীস শরীফের আলোকে একটি জু’মার খুৎবা রচনা ও সংকলন করে সমাজকে উপহার দেবেন। কিন্তু এর আগেই তিনি এলাকার জন্য অনেক কিছু করে আর বহু স্বপ্ন হৃদয়মাঝে নিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
আমরা যারা তার মত ক্ষণজন্মা পুরুষের উত্তরাধিকারী এখন আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে তাদের স্বপ্ন সৌন্দর্যকে বাস্তবে রূপদান করতে, এগিয়ে নিতে পিপাসার্ত বিভ্রান্ত সমাজকে সত্যিকারের মানযিলে মাকসুদের দিকে। যেখানে রয়েছে ইসলামের সত্যিকারের কর্মময় জীবন ও নূর নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পুত: হাতছানি। আল্লাহ মরহুম আবদুল ওহাব বি এ বিএড কে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট