চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন থাকতে হবে

অধ্যক্ষ ডা. রতন কুমার নাথ

৩০ মে, ২০১৯ | ২:১৭ পূর্বাহ্ণ

সারা জীবনের রোগ ডায়া বেটিস। একবার দেখা দিলে আর যেতে চায় না, একে মানিয়ে নিয়ে চলতে হয় সারাজীবন। সিন্দবাদের বুড়ো যেন ঘাড় থেকে নামতে চায় না আর। নতুন যুগের সিন্দবাদ আরো অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। জীব বিজ্ঞানের অনেক নতুন রহস্য আজ উদঘাটিত হয়ে আসছে।
মহান বিজ্ঞানী চিকিৎসক হানেমানের শিষ্যরা ডায়াবেটিসের বুড়োটাকে নতুন ধরনের সোমরস পানের ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। অনেকে অজান্তেই তাঁকে ডাকেন হ্যানি-ম্যান। চিকিৎসা জগতে তাঁর চিন্তা চেতনা অনেক দুরারোঘ্য রোগাবস্থাকে জীবনরাজ্য থেকে বিতাড়নের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। যারা ডায়বেটিসে আক্রান্ত হয়ে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তাদের জন্য হানেমানের পন্থায় উদ্ভাবিত ওষুধগুলো নিয়ে এসেছে নতুন আশার আলো।
হানেমান আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথির রাজ্যে ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত একশ’য়ের মত ওষুধ খুঁজে পাওয়া গেছে।
হোমিওপ্যাথির নীতি অনুযায়ী রোগীর ক্ষেত্রে যে কোন এক সময়ে একটি মাত্র ওষুধ প্রযোজ্য। যদি ওষুধটি তার জন্য উপযুক্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, তবে তার নির্ঝামেলার জীবন শুরু হয়ে গেল। টেবলেটের ঝামেলা নেই, ইনজেকশানের বালাই নেই। ওষুধের নির্ভেজালতা নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কটি গতানুগতিক না হয়ে আন্তরিক হয়ে উঠবে। ডায়াবেটিস ডায়াগনোসিসের জন্য রোগীর মধ্যে ফুটে উঠা লক্ষণগুলো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক তার বিবেচনায় নিয়ে আসেন এবং লক্ষণগুলো যাচাই-বাছাই করে এক সময়ে একটি মাত্র ওষুধ নির্বাচন করেন।
তার সঠিক প্রয়োগে রোগ লক্ষণগুলো দূর হতে থাকে একটার পর একটা। চিকিৎসার নীতি অনুযায়ী সর্বশেষে ফুটে উঠা লক্ষণটা সবার আগে চলে যাবে। আর, সবার আগের লক্ষণটা যখন চলে গেলÑ তখন আর কোন লক্ষণই রইল না- রোগী তখন সম্পূর্ণ নীরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে ওঠে।
আজকের বিজ্ঞান সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার (চঝণঈঐঙঝঙগঅঞওঈ উওঝঙজউঊজ) স্বীকার করে নিয়েছে, মনোদৈহিক বিশৃঙ্খলায় দেহের ওপরে মনকে প্রাধান্য দিয়েছে, রোগের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা রোগের হিমশৈল আবিষ্কার করেছেন। সে হিসেবে মনোদৈহিক বিশৃঙ্খলা থেকে সৃষ্ট রোগের হিমশৈল বহুদিন মানব জীবন রাজ্যে ঘাপটি মেরে থাকার পর ডায়াবেটিস নামক চূড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রোগের চূড়া নয়, পল্লবিত শাখা প্রশাখা নয়, রোগের জড়টাই কেটে দিতে বলে। জড়টা কেটে গেলে ধড়টাও আপনিই মরে যাবে। রোগের ধড়ফড়ানি আর থাকবে না।
রোগের জন্ম কথা : ডায়াবেটিস একটি রোগ। কিভাবে এর জন্ম হলো Ñ এ কেউ বলতে পারে না। রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে গেলে তবেই ডায়াবেটিস বলে রোগীকে চিহ্নিত করা হয়। রক্তে চিনির স্বাভাবিক মাত্রা ৮০-১২০ মিলিগ্রাম প্রতি ১০০ সি সি তে রক্তে চিনির মাত্রার পরিমাপ করা রসায়নের কাজ। চিকিৎসকের পরামর্শে যখন শারীরিক সুস্থতার পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয় তখন শরীর থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। সাধারণ মানুষ তার শারীরিক অসুবিধা দূর করার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডায়াবেটিসের রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষুধাধিক্য, পিপাসাধিক্য, প্র¯্রাবাধিক্য দেখা দেয়, প্র¯্রাব পরীক্ষায় চিনির মাত্রার বৃদ্ধি ধরা পড়ে।
ডায়াবেটিস রোগের জন্ম সম্বন্ধে একটি ধারণা নিতে শরীরে চিনির ব্যবহার সম্বন্ধে জানতে হবে। শরীরের দৈনন্দিন কাজ কর্মের জন্য যে শক্তির প্রয়োজন তা জোগান দেয় চিনি। খাদ্যবস্তু বলতে যা গ্রহণ করা হয় না কেন, তা শরীরের কাজে ব্যবহারের জন্য গ্লুকোজে পরিণত হয়। গ্লুকোজ হচ্ছে চিনির সরলীকৃত নাম, যা তরলিত অবস্থায় তাৎক্ষণিক ভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। এ যেন গাড়ীর পেট্রোল একে শক্তিতে পরিণত করতে চাই ইনসুলিন নামক হরমোন, এটা তৈরী হয় প্যানক্রিয়ার বিটাকোষের মধ্যে। এ হরমোন উৎপাদনে প্রভাব বিস্তার করে দেহের অন্যান্য হরমোন। বয়স বৃদ্ধির সাথে অনেক সময় চিনির বিপাকনে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
ইনসুলিনের ঘাটতি অথবা তার ব্যাহত কার্যক্ষমতা জনিত কারণে গ্লুকোজ সঠিকভাবে শক্তিতে পরিণত হতে পারে না। অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্ত¯্রােতে অতিরিক্ত ঘনত্ব সৃষ্টি করে। এটা বিপাকের জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত পানির। এর জন্য সৃষ্টি হয় অতিরিক্ত পিপাস, বেশী পানি পানে বর্জ্য হিসেবে বেশী প্র¯্রাব হয়। অতিরিক্ত কাজের জন্য চাই অতিরিক্ত শক্তি উৎপাদন খাদ্য, দেখা দেয় অতিরিক্ত ক্ষুধা। এসব যেন একটা নষ্ট চক্র। রোগ মানে জীবন রাজ্যে বিশৃঙ্খলা।
বিজ্ঞানের রাজ্যে শ্রেণী বিভাগ করলে দু’রকমের ডায়াবেটিস দেখা যায় Ñ ডায়াবেটিস মেলিটাস বা মধুমেহ। এটা প্যানক্রিয়ার ইনসুলিনের সাথে জড়িত। অপরটা হচ্ছে ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস বা পানিমেহ, এটা পিটুইটারী গ্ল্যান্ডের পেছন অংশ থেকে নির্গত এন্টিডাইউরেটিক হরমোনের সাথে সম্পৃক্ত। এতে মূত্রে শর্করার পরিবর্তে পানির আধিক্য দেখা দেয়। ডায়াবেটিস মেলিটাসকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১) আইডিডিএম বা ইনসুলিনযুক্ত ডায়াবেটিস এবং ২) এনআইডিডিএম বা ইনসুলিনমুক্ত ডায়াবেটিস। আইডিডিএম, শিশু ও কিশোর বয়সে দেখা যায়। এর রোগীর দেহের গড়ন সাধারণত হ্যাংলা পাতলা।
ত্রিশোর্ধ বয়স থেকে যারা অতি ওজন আর অতি ভোজনে ভোগেন তাদের এনআইডিডিএম দেখা দিতে পারে। এদের জীবন অন্যদের তুলনায় স্বল্পমেয়াদী হয় না, এদের যথাযথ চিকিৎসার জন্য ইনসুলিনের প্রয়োজন হয় না। এদের অবহেলা করলে এ রোগও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসার জন্য রোগ আর রোগীর লক্ষণগুলোর প্রাধান্য দেয়া হয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকগণ জীবনের বর্ণালীতে রোগীদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলীকে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসেন। সাধারণ চিকিৎসকেরা ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে তার রক্ত ¯্রােতে চিনির পরিমাণ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অনেক কারণ বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন। তার মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে ওষুধজনিত। কর্টিজোন ওষুধটি রক্তে চিনির বিপাক ক্রিয়াকে ব্যাহত করে। অন্য রোগের জন্য কটিজোন ব্যবস্থাপত্র দিতে বাধ্য হলে ডায়াবেটিস উৎপাদনের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্বন্ধে রোগীকে অবহিত করা চিকিৎসকের একান্ত কর্তব্য।
বৈজ্ঞানিকভাবে ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য মহান চিকিৎসক হানেমান এর আবিষ্কৃত তত্ত্বটা যত সহজ, উপলব্ধি করাটা তত কঠিন। একটা নাম দিয়ে সাধারণভাবে রোগী নিরূপণে হোমিওপ্যাথির তেমন আগ্রহ নেই। যেমন রয়েছে রোগীর মধ্য থেকে রোগ নির্বাচনে। তাই, রোগীর রোগের নির্বাসনের জন্য হোমিওপ্যাথি প্রকৃত ওষুধটি নির্বাচনে আগ্রহ। রোগ আর রোগী, তার সাথে যুক্ত হয় অনুসর্গ। যেমন, জীবনে অকৃতকার্যতার গ্লানিজনিত ঘটনা। এসব দিয়ে হোমিওপ্যাথ গড়ে তোলেন নিখুঁত এক রোগীচিত্র। এবার তিনি মেটেরিয়া মেডিকার আশ্রয় নেন এ রোগীচিত্রের সমরূপ একটা ওষুধ চিত্র খোঁজার জন্য। যত বেশী মিল খুঁজে পাবেন ততই তিনি আরোগ্যের মন্ত্রটি খুঁজে পেতে পারবেন। এভাবে তিনি গাণিতিকভাবে আরোগ্যের লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট