চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বদলে যাওয়া নাগরিক ঈদ : প্রবাসের দূরবীনে

আহমেদ শরীফ শুভ

২৮ মে, ২০১৯ | ১:৪৬ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র রমজানের শেষে ঈদুল ফিতর আমাদের দ্বারপ্রান্তে সমাগত। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ঈদকে বরণ করার নানা প্রস্তুতি চলছে। আমাদের এই ঈদপ্রস্তুতি আবহমান কালের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির অংশ। তবে, গত দু’ দশক ধরে দেশে ঈদের প্রস্তুতি আর উদযাপনের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। এই বদলটি দেশের ভেতর থেকে এবং এই বদলের অংশীদার হিসেবে কতটুকু টের পাওয়া যায় জানি না, তবে প্রবাসের দূরবীনে তা স্পষ্টই দৃশ্যমান। এই বদলটি গ্রামাঞ্চলে তেমন প্রকট না হলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ সবগুলো মহানগরীতে সুস্পষ্ট।
আমরা যারা প্রবাসে থাকি তারা দেশ থেকে ভৌগোলিক দূরে থাকি বটে। কিন্তু অস্তিত্বের বন্ধনে খুব বেশি দূরত্বে থাকি না আজকাল।
স্যাটেলাইট টিভি, ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেইসবুক সে দূরত্বকে কমিয়ে এনেছে অনেকটাই। টিভি, স্মার্টফোন আর ল্যাপটপের স্ক্রিনের সান্নিধ্যে আমরা মেলবোর্ণ কিংবা ম্যানহাটনে বসে দেশবাসীর আনন্দ-বেদনার অংশীদার হয়ে যাই মুহূর্তেই। অন্যান্য বারের মতো এবারের ঈদ প্রস্তুতি আর পরিকল্পনাও তার ব্যতিক্রম নয়। টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই নাগরিক জীবনের ঈদ পরিকল্পনা আর সেলিব্রেটিদের ঈদ পরিকল্পনা দেখা যায়। নাগরিক জীবন সেলিব্রেটিদের লাইফ স্টাইল দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত এ কথা বলাই বাহুল্য। এ ধারা দেখে মনে হয় আমাদের মহানগরীগুলোতে সম্প্রতি যেভাবে ঈদ উদযাপিত হয় তা আমাদের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনাগমের ঈদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা, অনেকটাই অচেনা।
সেই ছোটবেলা থেকে ঈদকে কেবল ধর্মাচার হিসেবেই নয়, দেখে এসেছি একটি সামাজিক উৎসব হিসেবেও। ঈদের নামাজ শেষে আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি, তারাও এসেছেন। ঈদ পরিণত হয়েছে বর্ধিত পরিবার আর বন্ধুবান্ধদের সামাজিক মিলনমেলায়। জেনেছি, এটাই ঈদের শিক্ষা। প্রবাসে জন্ম নেয়া আর বেড়ে উঠা আমাদের পরবর্তি প্রজন্মকেও এই শিক্ষাই দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা যারা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বাস করি তাদের ঈদের দিনে ছুটি নিতে হয়। কর্মদিবসে ছুটি নিয়ে আমরা স্বদেশি আমেজে ঈদ উদযাপন করি, সামাজিকতাকে লালন করি আর আমাদের সন্তানদের কাছে ঈদের ধর্মীয় ও সামাজিক আবেদনটি তুলে ধরার চেষ্টা করি।
হালে আমাদের মহানগরগুলোতে ঈদের প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা দেখে মনে হয় আমরা আমাদের সন্তানদের ঈদ উদযাপনের যে ঐতিহ্য শিখিয়েছি তা এখন সাবেকী হয়ে গেছে। সংবাদপত্র, টিভি রিপোর্টিং আর সেলিব্রেটিদের সাক্ষাতকার থেকে জানতে পারি দেশে এখন ঈদ উদযাপিত হয় ভিন্ন মাত্রায়। ঈদের নামাজ পড়ে ‘লম্বা ঘুম’ দেয়া এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ছেলেমেয়েরা বেড়াতে যাচ্ছে ফ্যান্টাসি কিংডমে, শিশু পার্কে, পতেঙ্গা সৈকতে, ফয়’স লেকে। কেউবা ছুটছে কক্সবাজারে। যারা আরেকটু ধনাঢ্য তারা ছুটছেন কাঠমন্ডু, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুরে। বর্ধিত পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের সাথে সামাজিক আতিথেয়তা বিনিময়ের কথাটি তেমন শোনা যায় না। যেন ঈদের প্রধান আকর্ষণ ঘুমানো, সৈকতে বেড়াতে যাওয়া কিংবা বিদেশ ভ্রমণ। এই প্রথাটি যে কেবলমাত্র সেলিব্রেটি কিংবা বিশেষ একটি শ্রেণীর মধ্যেই প্রচলিত তা নয়। আমার প্রখ্যাত এবং অখ্যাত সব ধরনের পরিচিতদের সাথে কথা বলেই জেনেছি এটিই এখন রীতি।
আমার এক বন্ধু ডাকসাইটে সরকারি আমলা। কয়েক বছর আগে ঈদে সপরিবারে নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। তার সাথে কথা হচ্ছিল বাঙালির ঈদের সামাজিক আবেদন, ঐতিহ্য আর তার পরিবর্তনশীল রূপ নিয়ে। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বললেন, ঈদ হচ্ছে একমাত্র সময় যখন পরিবারের সবাই একসঙ্গে ছুটি ভোগ করতে পারে। একই সময়ে বাচ্চাদের স্কুল কলেজ আর বাবা মায়ের অফিস বন্ধ থাকে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর এটাই তো একমাত্র সময়। তা ছাড়া ঢাকা চট্টগ্রাম এখন যান্ত্রিক শহর। সামাজিকতার মাধ্যম মোবাইলফোন আর ফেইসবুক। আতিথেয়তা বিনিময় তেমন একটা হয়ে উঠে না। সুতরাং যারা কাঠমন্ডু, ব্যাঙ্কক বা নিদেন পক্ষে কক্সবাজারের ফ্লাইট না ধরেন তারা যান ফ্যান্টাসি কিংডম কিংবা পতেঙ্গা সী-বীচে। যারা এর কোনটিতেই যান না বা বিভিন্ন কারণে যাওয়ার সুযোগ ঘটে না তাদের জন্য লম্বা ঘুমের বিকল্প আর কী ই বা আছে? বন্ধুটির যুক্তি অকাট্য। কিন্তু এই সত্যটি ইঙ্গিত বহন করেছে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের বর্ধিত পরিবারের বন্ধন এমনভাবে ভেঙে পড়ছে যে ঈদেও আমরা তাদের সাহচর্যের সুযোগ পাচ্ছি না। এখানেই নাগরিক বাঙালির ঈদ তার ঐতিহ্যগত সামাজিক আবেদনটি হারাতে বসেছে। কেউ কেউ হয়তো যান্ত্রিকতা ও দৈনন্দিন ব্যস্ততাকে দায় দেবেন। যান্ত্রিকতার আবরণে কিংবা অজুহাতে আমাদের নাগরিক ঈদ তার প্রথাগত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বটে, কিন্তু শতগুণে বেশি যান্ত্রিকতার শহর সিডনি, নিউইয়র্ক কিংবা লন্ডনে সহ¯্র বছরের ক্রিসমাস তার সামাজিক আর পারিবারিক আবেদনটি আজও হারায়নি। আজও ক্রিসমাস হচ্ছে পারিবারিক আর সামাজিক আতিথেয়তা বিনিময়ের দিন। এরাও অনেকেই ক্রিসমাসের বন্ধে দেশে বিদেশে ঘুরতে যান, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ২৫শে ডিসেম্বরের আগে কিংবা পরে, যাতে ক্রিসমাসের দিনটি বর্ধিত পরিবারের সাথে কাটাতে পারেন।
তবে কি অন্য সময়ে পরিবারের সবাই একসঙ্গে ছুটি না পাওয়ার কারণেই আমাদের ঈদের সামাজিক চালচিত্র বদলে যাচ্ছে? বিষয়টিকে আসলে এত সরলীকরণ করা সম্ভব নয়। বর্ধিত পরিবারের বন্ধন ক্রমশ হালকা হয়ে আসা, যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা, মহানগরীগুলোর ফ্ল্যাটে বন্দী-বিচ্ছিন্ন জীবন, একশ্রেণীর মানুষের অবৈধ উপার্জনের প্রাচুর্য সেই সাথে যোগ হওয়া প্রদর্শনকামিতা। এই সবই এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। তবে, পরিবারের সবার একসাথে ছুটি পাওয়ার বিষয়টিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ছুটি ভোগ করার অধিকার সরকারি-বেসরকারি সব কর্মকর্তা কর্মচারীরই রয়েছে। পরিবারের সব সদস্যরা যাতে ঈদ বাদেও বছরের একটি সময়ে অন্ততঃ (শীত অথবা গ্রীষ্মকালীন স্কুল ছুটির সময়) একসঙ্গে ছুটি কাটাতে পারেন তার ব্যবস্থা করা কি একেবারেই অসম্ভব? এই ব্যবস্থাটি করা গেলে ঈদে অন্তত বর্ধিত পরিবার আর প্রচলিত সামাজিক প্রথা উপেক্ষা করে দেশান্তরে ঈদ উদযাপনের হিড়িক কিছুটা হলেও কমে আসবে। অবশ্য যারা ঈদে দেশের বাইরে কিংবা দেশে অন্য কোথাও ঘুরতে যান তাদের সেই ভ্রমণকে ঈদ উদযাপন বলা যাবে না, নিতান্তই আনন্দ ভ্রমণ বলা যেতে পারে।

লেখক : মেলবোর্ন প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। কবি, গল্পকার, ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক ও সমাজকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট