চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জীবনের নিরাপত্তা ও হালাল রুজি করা অধিক সওয়াব

সালাহ উদ্দিন শাহরিয়ার

২৮ মে, ২০১৯ | ১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

লাভের মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: রমজান মাসের প্রথম রজনীর যখন আগমন ঘটে তখন শয়তান ও অসৎ জিনগুলোকে বন্দি করা হয়। জাহান্নাহামের দরজাগুলো বন্ধ করা দেয়া হয়, এ মাসে আর তা খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এ মাসে তা আর বন্ধ করা হয় না। প্রত্যেক রাতে ঘোষণাকারী এ বলে ঘোষণা দিতে থাকে যে, হে সৎকর্মের অনুসন্ধানকারী তুমি অগ্রসর হও। হে অসৎ অনুসন্ধানকারী তুমি থেমে যাও। এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। (তিরমিজি)
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন” (বাক্বারাহ ২৭৫)
এ আয়াত খেকে বুঝা যায়, ইসলাম উপার্জনের পেশা হিসাবে হালাল পথে ব্যবসাবাণিজ্য করতে, যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি অবৈধ পথে অর্থসম্পদ-উপার্জন করতেও নিষেধ করেছে। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন করে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও এ শেষ পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই অন্যায়, জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, মজুদদারী ইত্যাদি অবৈধ ও ইসলামবিরোধী কার‌্যাবলী পরিহার করে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাঅপরাধী হিসাবে উপনীত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’।
ক্বিয়ামতের ময়দানে কঠিন শাস্তি হতে মুক্তি পেতে হলে আল্লাহভীতি সহকারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। কাউকে সামান্যতম ঠকানোর মানসিকতা অন্তরে পোষণ করা যাবে না। তাছাড়া, মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মওজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকেও বিরত থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে মওজুদকারী সে পাপী।
পন্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সকল ব্যবসায়ীকে মিথ্যা বর্জন করতে হবে। কারণ, তা ইসলামে নিষিদ্ধ। আবু কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হতে বিরত থেকো। এর দ্বারা মাল বেশী বিক্রি হয় কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়’।
তাই ইসলামের দৃষ্টিতে গুদামজাত করে কৃত্রিম উপায়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে অতিরিক্ত লাভ করা হারাম। ওজনে কারচুপি করা এবং খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে মৃত্যু ঝুঁকিতে নিয়ে যাওয়া নিশ্চয় একটি কবিরা গুনাহ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। দ্রব্যের কোন দোষ-ক্রটি থাকলে ক্রেতার সম্মুখে তা প্রকাশ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। কোন প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম (সাঃ) কোন এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তার হাত ভিজে গেছে। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপারে কি? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! বৃষ্টিতে উহা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, তাহলে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়’।
ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষেত্রে ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া এবং দেওয়ার সময় কম দেওয়া ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের ধ্বংস অনিবার্য।
ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে ইহকাল-পরকালে কল্যাণ ও মুক্তিলাভ সম্ভব হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ওজনে কম-বেশী করা গুরুতর অপরাধ। এতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর প্রতারক শ্রেণীর মানুষ সাময়িকভাবে লাভবান হয়, যা ইসলামে কাম্য নয়।
রমজানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার প্রবণতা :
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়ীরা রমজান মাসে হালাল রুজি, বরকত আর সওয়াবের লক্ষ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্রব্যমূল্য হ্রাসসহ বিভিন্ন আয়োজন করে। তাদের কাছে ব্যবসায় মুনাফার পরিবর্তে আত্মশুদ্ধির আর আল্লাহর ভয় কাজ করে।
তবে, ভিন্ন চিত্র বাংলাদেশে রমজান এলেই। এ দেশের মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য মনুষ্যত্ব আর বিবেককে খুন করে। অমান্য করে আল্লাহর নিষেধকে। রমজানের পূর্বেই তারা কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফার লক্ষ্যে মালামাল গুদামজাত করা শুরু করে। শুরু করে খাদ্যে ভেজাল মিশানো। পচা আর বাসি খাবার বিক্রি। বড় বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে সমগ্র বাজার। দ্রব্যমূল্যের অত্যাধিক চাপে নাভিশ্বাস উঠে জনজীবনে, অতিরিক্ত ভেজাল মিশানোর কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। নিশ্চয় এমনতরো গর্হিত কাজ ধর্ম আর দেশের ভোক্তা আইন এবং সমাজ সমর্থন করে না।
এ প্রসঙ্গে আমরা প্রতিদিন লক্ষ্য করছি দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যে ভেজাল পাওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। শুধু রমজানে নয়, সারা বছরই মনিটরিং করা উচিৎ।
তবে, সবচেয়ে আশ্চর্য আর দুঃখজনক বিষয় হলো, স্বনামধন্য এ সমস্ত ব্যবসায়ী যখন আবার সওয়াবের আশায় কিছু মানুষকে লাখ লাখ টাকার যাকাত দান করে। এই সব মুনাফালোভী মানুষগুলো আবার আত্মপ্রচারের লক্ষ্যে কোনরূপ নিরাপত্তার ব্যবস্থা না রেখে যাকাত বিতরণে নামে। আর, তাতে অনেক সময় অতিরিক্ত ভীড়ের জন্য পদদলিত হয় যাকাত প্রার্থীরা। এভাবে তারা মানুষও হত্যা করে। আবার, সে নির্মম দুর্ঘটনার বিচার থেকেও কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায় রক্ষাও পেয়ে যায়।
সেই সমস্ত ব্যবসায়ীদের কাছে প্রশ্ন, নিশ্চয় তাদের জানা থাকার কথা- আল্লাহতালা অতিরিক্ত মুনাফা, ওজনে কারচুপি, খাদ্যে ভেজাল প্রদান করে মানুষকে মৃত্যু ঝুঁকিতে নিয়ে যাওয়াকে হারাম করেছে। আল্লাহতালা হালাল রুজির উপর যাকাত ফরজ করেছেন হারাম রুজির উপর নয়। তাই, অতিরিক্ত সওয়াবের আশায় যারা সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে অবৈধ মুনাফা অর্জন করে, এবং লোক দেখানো যাকাত আদায় করেন, তাদের জন্য নিশ্চয় আল্লাহতালা নেকি এর পরিবর্তে শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন।
তাই, যে সমস্ত ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেট মানুষের কাছ থেকে অবৈধভাবে মুনাফা আদায় করে কিছু মানুষকে সাহায্য করছেন সওয়াবের আশায়, তাদের প্রতি অনুরোধ কয়েক জনকে খুশী করার চেয়ে সাধারণ জনগণকে স্বস্তিতে রাখা অনেক বেশী সওয়াবের। অবৈধ মুনাফায় অর্জিত সম্পদের যাকাত দিয়ে সওয়াব আদায়ের চেয়েও কম মুনাফা করে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও হালাল রুজি করা অধিক সওয়াব নয় কি?
পরিশেষে বলা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীকে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে, অবৈধ উপার্জন ও লোভ-লালসাকে সংবরণ করতে হবে। আর, এটাই ইসলামের দাবী। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ইহকালে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন ও পরকালে মুক্তি লাভের তাওফীক দান করুন।

লেখক : ডেপুটি রেজিষ্টার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট