চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আইনি ও সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি

লকডাউনেও নারীর প্রতি সহিংসতা

সম্পাদকীয়

১২ মে, ২০২০ | ২:৪০ পূর্বাহ্ণ

সরকারের নারীবান্ধব নীতির কারণে নারীরা সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। এটি আমাদের জন্যে একটি আশা জাগানিয়া সুখবর নি:সন্দেহে। কিন্তু যে হারে নারীর অগ্রগতি হয়েছে সে হারে কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি আশানুরূপ। বরং ক্রমান্বয়ে এ সহিংসতা বেড়েই চলেছে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) তথ্য অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণজনিত লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যেই গত এপ্রিল মাস জুড়ে ২৭ জেলায় চার হাজার ২৪৯ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। করোনা সংকটের কারণে চলমান অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত পরিস্থিতিতে যেখানে নারীরা অধিক সহানুভূতি পাওয়ার কথা, সেখানে তাদের প্রতি সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৪৮ নারী, মানসিক নির্যাতনের শিকার ২০০৮ জন, যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৫ জন এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩০৮ নারী। এর বাইরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চার নারী, হত্যা করা হয়েছে এক জনকে এবং যৌন হয়রানি করা হয়েছে ২০ নারীকে। উল্লেখ্য, করোনাজনিত লকডাউন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নারী ও শিশুরা কেমন আছে তা জানতে এমজেএফের দুটি প্রকল্পের ২৪টি সহযোগী সংগঠন, ২৭ জেলার ৫৮ উপজেলার ৬০২ গ্রাম এবং চারটি সিটি করপোরেশনের ১৭ হাজার ২০৩ নারী ও শিশুদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করে এপ্রিল মাসে সংঘটিত সহিংসতা ও নির্যাতনের এই তথ্য উদঘাটন করেছে। প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, যে নারী আগে কখনই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়নি লকডাউন পরিস্থিতিতে সেও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তবে করোনাকালে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও নারী নির্যাতন বেড়ে গেছে। করোনাকালে পরিচালিত বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট বলছে, করোনাজনিত লকডাউনের সময় বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী লকডাউন পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, চীন, মালয়শিয়া, ভারত, আর্জেন্টিনা এবং তিউনিশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যেখানে প্রতি তিনজনে একজন নারী সহিংসতার শিকার হতেন, সেখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো কোনো রাষ্ট্রে প্রতি তিনজনে দু’জন নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। দিনকয়েক আগে জাতিসংঘ মহাসচিব এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সহিংসতা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কিছুদিন আগে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বিনোদনমূলক শিক্ষার’ ভূমিকা শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপিত গবেষণামূলক প্রবন্ধে তথ্য উপস্থাপন করা হয়, সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ শতাংশ নারী কোন না কোনভাবেই যৌননির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশে এ হার ৬০ শতাংশ। পারিবারিক বা নিকট আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীরাই বেশী যৌননির্যাতনের শিকার হন বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর নানা গবেষণায়ও এ ধরনের চিত্র আগে বহুবার উঠে এসেছে। পত্রপত্রিকার নানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও নারীর ওপর যৌনসন্ত্রাসসহ নানাবিধ সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু এর মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে খামখেয়ালির কারণে নির্যাতন রোধে কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। পরিণামে এখন করোনাকালে নারীনির্যাতন বেড়েগেছে।
আমরা মনে করি, জরুরি ভিত্তিতে নারীর প্রতি এ ধরনের সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেসব দুর্বৃত্ত নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ঘটাচ্ছে, তারা পশুচরিত্রের অধিকারী। কোনো মানবিক মানুষ এমন জঘন্য আচরণ করতে পারে না। এদের বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। লকডাউন পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে এমজেএফ ১০৯ ও ৯৯৯ হেল্পলাইনগুলো আরও কার্যকর রাখা, সহিংসতার শিকার নারীরা ফোন করার সঙ্গে সঙ্গেই সহায়তা পাওয়া, ভুক্তভোগী নারীকে সরকারী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দ্রুত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, সহিংসতার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, করোনাপরিস্থিতিতেও নারী ও শিশুনির্যাতন ট্রাইব্যুনাল এর কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য ‘ভার্চুয়াল কোর্ট অর্ডিন্যান্স’ দ্রুত রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের ব্যবস্থা করাসহ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। এসব সুপারিশও আমলে নেয়া উচিৎ। এছাড়াও জনসচেতনতা তৈরি, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে চিন্তা করা, নিজেদের মধ্যে বোধ তৈরি করা, আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, প্রত্যেকটি স্কুলে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে যে কমিটি আছে তা কার্যকর করা, গণমাধ্যমে নারীকে বিকৃতভাবে বা বাণিজ্যিকভাবে উপস্থাপন না করা, নারী বিষয়ক সংবাদের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রে যথাযথভাবে তুলে না ধরা, সরকারের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা, নারীকে উৎপাদক হিসেবে দেখা, কিশোর-কিশোরীদের সচেতনতায় বায়োলজিক্যাল শিক্ষায় আগ্রহ করে তোলা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি পদক্ষেপও নেওয়া যেতে পারে। কার্যকর ফল পেতে বিনোদনমূলক শিক্ষা, যেমন পথ ও মঞ্চ নাটক জারি গান, পালা গান, কুইজ শো, বিতর্ক প্রতিযোগিত, ভিডিও শোর ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি তরুণদের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্যাম্পেইন বাড়াতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট