চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর (১৯৩২-১৯৮৬)

হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান

১২ মার্চ, ২০২০ | ২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

আজ আমার মা মরহুমা ডা. নুরুন নাহার জহুর এর ৩৪তম মৃত্যুবাষির্কী। তিনি ১৯৩২ সালের ১২ ডিসেম্বর বার্মার (মায়ানমার) রেঙ্গুনে আমার নানার কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিশু ও শৈশবকাল কেটেছে রেঙ্গুনে। তিনি ১৯৪২ সালে চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাসটিকাস স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৯ সালে গুলএজার বেগম হাই স্কুল হতে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুল এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে এলএমএফ ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামে জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত ফ্যামেলি প্ল্যানিং বিভাগে চট্টগ্রাম জিলার মেডিকেল অফিসার হিসাবে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের পাশাপাশি তিনি রাজনীতি, সমাজসেবা, সহিত্যিক কর্মকা-সহ নানা কর্মকা-ে আমৃত্যু সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। উনার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৯ সালে যখন উনি চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৫০ সালে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্ররাজনীতি থেকে পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের জন্ম হওয়ার পর তিনি ১৯৫০ সাল হতে ১৯৮৬ সাল মৃত্যুর পর্যন্ত আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। ১৯৫২-৫৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের কার্যকরী সংসদের সদস্য নির্বাচিত ও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম ভাষার দাবীর মিছিল পরিচালনা করেন। তিনি তখন তমুদ্দিন মজলিশের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে কর্মকা- পরিচালনা করেন এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন পরবর্তীতে ১১ দফা এবং ৬৯ সালের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম মহিলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামীলীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সক্রিয়ভাবে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাথে চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামীলীগের পুনর্গঠনের সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং কাজ করেন। তিনি ১৯৭৫-৮৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য (আমৃত্যু) ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামীলীগের জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কাজ করার সময় আমার পিতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সাথে পরিচয় এবং পরবর্তী ১৯৫৫ সারে বিবাহ হয়।
৬০ দশকে ৬ দফা, ১১ দফা, আয়ুব বিরোধী আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন টানা ১৯৬০ সাল হতে ১৯৭১ সার পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ঘোষিত আন্দোলন সংগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং চট্টগ্রামের মহিলাদের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামে মহিলাদের সংঘটিত করেন এবং আগ্রাবাদ এবং ওআর নিজাম রোডে মহিলাদের যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করেন এবং ২ মার্চ বিকাল তিন টায় ঐতিহাসিক লালদিঘির ময়দানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিশাল সমাবেশে চট্টগ্রামের মহিলাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১টা ৩০মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দামপাড়া বাসায় ৮০৭৮৫ টেলিফোন-এ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানোর জন্য ফোন করেন। তখন আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরী চট্টশ্বরী সড়কের মেডিকেল হোস্টেল এর বিপরীতে পাহাড়ের উপর ওয়াপদা রেস্ট হাউজে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগের নেতা ও কর্মীদের সাথে অবস্থান করছিলেন। আমার মা টেলিফোন কলটি গ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ডিকটেশন দেন এবং আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর নিজের হাতে লিখে নেন এবং তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রেরিত স্বাধীনতা ঘোষণাটির কয়েক কপি লিখে নেন। এক কপি আমার বাবার নিকট প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম শহরে প্রচারের জন্য বাংলা অনুবাদ করে তিন আওয়ামী লীগের তৎকালিন নেতা-কর্মী প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে জনাব ইদ্রিস আলম, বদন দিদারী, বদিউল আলম, নুর মোহাম্মদ, মোস্তাকিম বিল্ল্যাহ, ইলিয়াস চৌধুরী ভোর রাত্র থেকে চট্টগ্রাম শহরে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী প্রচার করেন এবং আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা শহরের অলি-গলিতে স্বাধীনতার ঘোষণাটি দুপুর পর্যন্ত প্রচার করে। এই কাজের নেপথ্যে সবচেয়ে বেশী যার ভূমিকা ও পরিচয় না দিলে অকৃতজ্ঞতা হবে। তার নাম নুরুল হক, চট্টগ্রাম শহর আওয়ামীলীগের পিয়ন। নুরুল হক আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরীর যাবতীয় কাজ করতেন। সে আমার মায়ের নিকট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীটি সংগ্রহ করে। প্রথমে আমার বাবাকে পৌঁছায়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহরের নেতা-কর্মীদের বিলি করেন। এমনকি সে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কপি করে সারা শহরের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে তা বিতরণ করেন। “নুরুল হক”-এর অবদান ও ইতিহাস চট্টগ্রাম শহর আওয়ামীলীগের ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। নুরুল হকের নাম ছাড়া চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের ইতিহাস লিখা কখনো পরিপূর্ণ হবে না।
আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য ও সমাজসেবামূলক সংঘটনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪২ সালে আজান পত্রিকার মুকুল মেলার সদস্যা ছিলেন। এরপর মুকুল ফৌজ এর সদস্যা ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে এই সংঘটনে কাজ করেছেন। ১৯৫১ সালে আমাদের মাহফিল, চাঁদের হাট সংগঠন পরিচালনা করছেন। ১৯৪৯ সালে লিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (আপোয়া) বর্তমান মহিলা সমিতির চট্টগ্রাম শাখার সদস্য হন। ১৯৫৭ সালে সমাজকল্যাণ ও স্বাস্থ্য সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬২ সালে মহিলা সমিতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এককভাবে প্রতিষ্ঠা করেন (বর্তমান বাংলাদেশ মহিলা সমিতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ বা বাওয়া স্কুল)। ধীরে ধীরে এই স্কুল সুনামের সাথে এগিয়ে যেতে থাকে লিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির (আপোয়ার) তত্ত্বাবধানে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা অগ্রগতি এবং জমি সবই আপোয়া অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দেওয়া। আমার মা ড. নুরুন নাহার আমৃত্য এই সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭২ সালে সভানেত্রী এবং পরবর্তীতে সহ-সভানেত্রী দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪২ সালে আমার মায়ের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা কল্পনা দত্ত এবং তার বোন রমলা দত্ত ছিলেন আমার মায়ের ক্লাস টিচার। তাঁর সান্ন্যিধ্যে এসে আমার মা বৃটিশবিরোধী আন্দোলন এবং চট্টলার ইতিহাস তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জেনেছেন। আমার মা ছিলেন বইপ্রেমী। আমৃত্য প্রতিদিন ভোর সকাল থেকে কোরআন শরীফ তেলওয়াত দিয়ে শুরু করতেন এবং দৈনিক পত্রিকা পড়ার পর বইপড়া ও লেখালেখি শুরু করতেন। তিনি ঐতিহাসিক “বেগম পত্রিকার” লিয়মিত লেখক ছিলেন। শুধু বেগম পত্রিকা নয় তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে আমৃত্যু ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বেগম, সত্যবার্তা, কাফেলা, ইত্তেফাক, আজাদী, কোহিনুর, সৈনিক, হেরেম, আমান, পূরবী প্রভৃতি পত্রিকা ও সংকলন ও মাসিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তিনি ১৯৪৯ সালে যশোর সাহিত্য সংঘ কর্তৃক প্রদত্ত “সাহিত্য রতœ” উপাদি লাভ করেন। ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত নিজ সম্পাদনা ও উদ্যোগে ২১শে সংকলন “রক্তরাঙ্গা ফাল্গুন” সংকলন প্রকাশিত করেন। ১৯৭২ সালে লেখিকা সংঘ ঢাকার কার্যকরী সংসদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ ঢাকার “মেগদূত” সাংস্কৃতি সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সাল হতে আমৃত্যু চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের উপদেষ্ঠার দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুজিব নগর স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা উপদেষ্ঠা হিসাবে কাজ করেন এবং আগরতলা জিপি হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতে ডাক্তার হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত এ কাজে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি আমার বাবার বিএলএফ অফিসের কাজ-কর্মে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিতেন। স্বাধীনতা উত্তর নির্যাতিত অসহায় নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস হতে কাজ শুরু করেন।
১৯৭২ সালে আমার পিতা মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা, শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রীসভার মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরুর প্রথম দিনেই আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর কে চাকুরী হতে অব্যাহতি প্রদান করেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে। পরে আমার মা ব্যক্তিগত উদ্যোগে রোগীর সেবা দেওয়া শুরু করেন। উল্লেখ্য, তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের পরিবার পরিকল্পনা প্রজেক্টে কাজ করেছেন। তিনি যা বেতন পেতেন তা দিয়ে আমাদের ভাই-বোনদের লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়াসহ জীবন-জীবিকা ভালোভাবেই চলেছে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরী মৃত্যু হলে এবং ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক সংকটের পর আমাদের পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, পড়ালেখাপাড়ার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার মায়ের চাকুরী না থাকার কারণে আমাদের অর্থনৈতিক সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করে। ১৯৭৫ সাল হতে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আমাদের পরিবারের সংকটকালীন সময়গুলো মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি। ১৯৭৯ সালে আমার মা তার পিতা থেকে পাওয়া সম্পত্তি খাতুনগঞ্জে (বর্তমানে এবি ব্যাংক বিল্ডিং) বিল্ডিং এবং দেওয়ান বাজার এ হোম বেকারী বিল্ডিংটি বিক্রি করে দেন। এতে আমাদের জীবনে নতুন গতির সঞ্চার হয় এবং পড়ালেখা শেষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠার সুযোগ হয়। আমরা মায়ের অবদান একটি রাজনৈতিক পরিবারে কি পরিমান ভূমিকা রেখেছে তা আমি লিখে কখনো শেষ করতে পারবো না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট