চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অষ্টম কলাম

মানুষের পরিচয়ে বিভক্তি-বিভেদ

জুবায়ের আহমেদ

১১ মার্চ, ২০২০ | ২:০৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কে কোন ধর্মে, কোন গোত্রে, কোন সমাজে কিংবা কোন দেশে জন্ম নিয়েছে তা ছাপিয়ে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানুষ। পৃথিবীর যে প্রান্ত কিংবা যেখানেই মানুষের জন্ম কিংবা বসবাস হোক না কেনো, অপর প্রান্তের, অপর দেশের যেকোন মানুষের কাছেই অপর একজনের পরিচয় উভয়েই মানুষ, উভয়েই সৃষ্টিকর্তার সেরা সৃষ্টি। কে কালো, কে ফর্সা কিংবা কে খাটো কে লম্বা, কে গরীব, কে ধনী, কে রাজা বা কে প্রজা, কোন ধর্মই মানুষের মধ্যে এভাবে শ্রেণী বিভেদ-বিভক্তি তৈরী করেনি।
যুগে যুগে মানুষ বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত হয়েছে, সময়ের বিবর্তনে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন আজ কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ হিন্দু এবং আরো বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি ধর্ম তথা ¯্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসীর সংখ্যাও পৃথিবী জুড়ে কম নয়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, ধর্মের অপব্যাখ্যা করা, ব্যক্তি স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা ব্যক্তিদের কারণে ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রত্যেক মানুষের মূল পরিচয় মানুষ এবং সকলেই মানবিক গুণাবলি নিয়ে জন্ম নিলেও মানুষে মানুষে বিভক্তির বিষয়ে প্রথমত মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত হয়েছে, কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিষ্টান, কেউ ইহুদি, কেউ বৌদ্ধ, কেউ হিন্দু, আরো কত ধর্ম। যদিও প্রত্যেকটি স্বীকৃত ধর্মেই মৃত্যু পরবর্তী জীবনে শাস্তি ও শান্তির প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও এই বিভিন্ন ধর্মের মানুষগুলোর মধ্যেও শত বিভক্তি রয়েছে, মূলত সেসব বিভক্তির কারণেই অবস্থাভেদে আজ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের কর্মকান্ড মানবিকতাকে পেছনে ফেলে হিং¯্র থেকে হিং¯্রতর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বলা হয় মুসলিম। তবে মুসলিম পরিচয় ছাপিয়ে আজ কেউ সুন্নি, কেউ শিয়া, কেউ সালাফি, কেউ কওমি সহ আরো বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত হয়েছে। হিন্দুদের মধ্যে ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য (কপালী), কায়স্থ সহ আরো কয়েকটি জাতে বিভক্ত। খ্রিষ্টানদের মধ্যেও আছে বেশ কয়েকটি শাখা বা মন্ডলী, যার মধ্যে রোমান ক্যাথলিক মন্ডলী, প্রতিবাদী মন্ডলী, পূর্বী প্রথানুবর্তী মন্ডলী, প্রাচ্যদেশীয় প্রথানুবর্তী মন্ডলী এবং ইঙ্গ (অ্যাংলিকান) মন্ডলী, এছাড়াও বিভিন্ন মতের অনেক মন্ডলী রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যেও থেরবাদ, মহাজান ও ব্রজযান শাখা সহ আরো শাখা রয়েছে। (তথ্যসূত্র উইকিপিডিয়া)
সব পরিচয় ছাপিয়ে মানুষের পরিচয় মানুষ। সকল ধর্মগুলোকেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান এবং বিপদে আপদে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকেই দিয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মান। একজন মানুষ যে ধর্মের কিংবা যে জাতেরই হোক কিংবা ধনী-গরীব যেই হোক, মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে তার পাশে দাঁড়াতে বলা হয়েছে কিন্তু মানুষের মাঝে বিভিন্ন ধর্মের পাশাপাশি ধর্মের মধ্যেও বিভিন্ন শাখা-জাতে বিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে মানুষের রাজনৈতিক পরিচয়, অর্থনৈতিক পরিচয়, সাংগঠনিক পরিচয় বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে উল্লেখিত ধর্মীয় বহু বিভক্তির পরও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেউ আওয়ামীলীগ, কেউ বিএনপি-জামায়াত, কেউ জাতীয় পার্টি, কেউ কেউ বামদলগুলোর অনুসারী। আবার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলিম হওয়ার কারণে মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন পীর-আউলীয়াদের অনুসারী, তাবলীগ-জামায়াতের মধ্যেও বিভিন্ন বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। এসব বিভক্তির কারণে মানুষের ধর্মীয় মূল পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় ছাপিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় এবং অর্থনৈতিক পরিচয় বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুন্দর ভাবে বাঁচার জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে এবং সাংগঠনিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরী হলেও এবং একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবেই সম্মান করার কথা থাকলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সে মানুষটি হিন্দু না মুসলিম, সে আওয়ামীলীগ না বিএনপি, সে সুন্নি না সালাফি না কওমি, সে ধনী না গরীব, শিক্ষিত না অশিক্ষিত এসব পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর মানুষটির সাথে কথাবার্তা কিংবা আচরণ কেমন হবে তা নির্ণয় করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে মানুষটি নিরীহ প্রকৃতির হলেই যেনো তাকে তুচ্ছ্য তাচ্ছিল্য করা, অপমান করা, হেয় করা, ঘায়েল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে রাজনৈতিক কিংবা-অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিরা, যা কাম্য নয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, সব ধর্ম ও মতাবাদ মতেই মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে, অর্থবিত্ত ও ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক-ধর্ম-জাতগত পরিচয় ছাপিয়ে একজন মানুষ অপর মানুষের কাছে সর্বোচ্চ সম্মান, সহানভূতি, সহমর্মিতা, ভালোবাসা, বিপদে আপদে সহযোগিতা পাবে, পৃথিবী হবে সত্যিকার অর্থেই মানুষের জন্য, সেই দিনের প্রত্যাশা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট