চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দপ্তর ব্যবস্থাপনায় সামাজিকীকরণ

ওবায়দুল করিম

১০ মার্চ, ২০২০ | ২:৪১ পূর্বাহ্ণ

সমাজবিজ্ঞান বলে, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি, সমাজের আদর্শ, মূল্যবোধ, আইন-কানুন, রীতি-নীতি, ধর্ম ইত্যাদির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার যে প্রক্রিয়া, তাই হলো সামাজিকীকরণ। মৃত্যুর আগে মানুষের বয়োবৃদ্ধি হয়। শিশু, কিশোর, তরুণ, যুব ও প্রৌঢ় হিসেবে মানুষের কাল কাটে। সব কালের দেহ, মন আর খাপ খাইয়ে নেবার প্রক্রিয়া আর ফল এক নয়। শিশুর জন্ম পরিবারের পরিবেশে। সে পায় রক্তের সম্পর্কের ছোট পারিবারিক পরিবেশ। পারিবারিক আদর্শ, বিশ্বাস আর মূল্যবোধের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। শুরু হয় সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া। স্কুলে যখন শিশু যায় রক্তের সম্পর্কের বাইরে বৃহত্তর সামাজিক সম্পর্কে সে পা ফেলে। শেখে শিষ্টাচার, আদব-কায়দা ইত্যাদি। বিজ্ঞান, সমাজ, পরিপার্শ্ব এসময়ে তাঁর ধারণায় আসে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা শেষে আসে কর্মপরিধিতে।
জীবনের এক নয়া সন্ধিক্ষণের শুরু হয়। যতদিন শক্তি ও সামর্থ্য থাকে ততদিন থাকে কর্মপরিধিতে। সাধারণত এ কর্মপরিধি বিস্তৃত থাকে কর্মভেদে ষাট, পঁয়ষট্টি, সত্তুর বছর পর্যন্ত। পরের সময় একবারেই অবসরের সময়। জনসংখ্যাবিজ্ঞানে উবসড়মৎধঢ়যরপ উরারফবহফ বা চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ইড়হঁং বলে শব্দ প্রচলিত আছে।এর অর্থ হলো, কোন দেশের জনমিতিতে যুবক বা কর্মসামর্থ্যের জনসংখ্যা স্ফীত হওয়া। একটি সমাজে শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধদেরও অবস্থান থাকে। ঐ সমাজে যদি শিশু ও বৃদ্ধদের তুলনায় যুবকদের সংখ্যা বাড়ে, তাহলে কর্মক্ষম জনসংখ্যারই বৃদ্ধি হয়। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধি মানেই সমাজে উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কারণ শিশু ও বৃদ্ধরা শুধুমাত্র ভোক্তা, উৎপাদক নন, উৎপাদক হচ্ছে যুবকেরা বা কর্মসমর্থরা। এজন্যই জাতিসংঘের ঝউএ বা ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষ এ যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। অবশ্যই স্মর্তব্য যে মধ্যবিত্তের বিকাশ ও যুবকদের সংখ্যাবৃদ্ধি হাত ধরে চলে। সমাজবিজ্ঞানী ঞযড়ৎংঃবরহ ইঁহফব ঠবনষবহ তাঁর “ঞযবড়ৎু ড়ভ খবরংঁৎব ঈষধংং” এ অবসরভোগী শ্রেণির (মধ্যবিত্ত, যাঁরা কায়িক শ্রম থেকে মুক্ত) উদ্ভবের সাথে সমাজ ও অর্থনীতির বিকাশের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। মধ্যবিত্ত ও যুবসমাজের সংখ্যা বৃদ্ধি বলা যায়, উন্নয়নের এক বড় শর্ত।
সামাজিকীকরণ বয়স, শ্রেণি ও মর্যাদাভেদে ভিন্ন মাত্রার হয়। শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, শিক্ষক এঁরা মধ্যবিত্ত বা অবসরভোগী শ্রেণি (কায়িক শ্রম থেকে মুক্ত, এই অর্থে)। এই শ্রেণী থেকেই ক্ষমতায়ণের সোপান তৈরি হয়। এঁরা হতে পারেন, আমলা, প্রশাসক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, কেরানী ইত্যাদি। এঁদের কর্মস্পৃহা ও প্রেষণা জাতি গঠনের এক প্রধান উপাদান। এঁরাই উৎপাদক। সমাজে বস্তুগত ও অবস্তুগত দ্রব্য-সামগ্রী এঁদের কর্মপরিচালনার ফল। সুতরাং এই জনগোষ্ঠীর কর্মপরিবেশ ও সামাজিকীকরণ জাতি গঠনে ও উন্নয়নের এক বিশাল ভূমিকা রাখে।
সমাজে যাঁরা সরাসরি পণ্য বা বস্তুগত বা মানসিক, যাই হোক না কেন, উৎপাদনে জড়িত তাঁদের বয়স ২১ থেকে ৭০ পর্যন্ত হিসাবে রাখতে পারি।এঁদের কায়িক শ্রমকারীরা ৫৫, ৬০ বছরের ভেতরেই কর্মপরিবেশের বাইরে চলে যান। যাঁরা মানসিক ও বৌদ্ধিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত, তাঁরা সরকারী, বেসরকারী অথবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আমরা জানি, সমাজে রয়েছে হাজারো দল (গ্রুপ), সংঘ, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। কখনোই কোনো মানুষের অস্তিত্ব দল, সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হয় না। ব্যক্তি মাত্রই কখনো পরিবার, কখনো কোনো সংগঠন বা কোন গ্রুপের সদস্য হিসেবে থাকেন। পরিবার একটি দল আবার প্রতিষ্ঠানও বটে। পরিবারের রয়েছে মূল্যবোধ। এটিও প্রতিষ্ঠান, কারণ এর রয়েছে প্রতিষ্ঠিত কার্যাবলী। পরিবারের সদস্যরা পরিবারের মূল্যবোধ মেনে চলে বলেই পরিবার থাকে সংঘবদ্ধ। এ মূল্যবোধ না মানলে, পরিবারের সংহতি ভেঙে যায়, ফলে হাজারো পরিবার ভেঙে গেলে, সমাজ টেকে না। কারণ পরিবার হলো সমাজের একক। পরিবারের সদস্যরা সামাজিকীকরণের মাধ্যমে পারিবারিক মূল্যবোধকে ধারণ করে। রক্তের সম্পর্ক পারিবারিক সংহতিকে দৃঢ় করে।
উৎপাদক মধ্যবিত্ত ও মধ্যবয়সীদের কর্মপরিধিতে এই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা খুুব বেশি। মোটামুটি যাঁরা ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ফরারফবহফ হিসেবে বিবেচিত তাঁদের কর্মপরিবেশ ও কর্মযজ্ঞের উপর কোন দেশের মূল ভবিষ্যৎ নির্ধারিত। সামাজিকীকরণের প্রাতিষ্ঠনিকীকরণ অত্যন্ত জরুরী। অনিয়ম আর দুর্নীতি আমরা যা বলি তাঁর শুরু কর্মপরিবেশ থেকে। লালফিতার দৌরাত্ম, তাও এখান থেকে। অজ্ঞানতা অনিয়মের জন্ম দেয়। স্বার্থপরতা অনিয়ম ও শেষে দুর্নীতির সৃষ্টি করে।
বলা হয়ে থাকে শুধু শিক্ষাগত সার্টিফিকেট নয়, কম্পিউটার লিটারেসি বা সাক্ষরতাও দরকার। কম্পিউটার লিটারেসির সাথে নেটিজেন ও কম্পিউটার চালনার শিষ্টাচার যেমন জানা প্রয়োজন ঠিক তেমনি অফিস ব্যবস্থাপনায় শিষ্টাচার ও নিয়ম-কানুনের জ্ঞান থাকাটা অতীব প্রয়োজন- যাকে সেক্রেটারিয়াল সায়েন্স বলা হয় যা অফিস ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন। আর এর সাথে জানানোর প্রক্রিয়াকে মধ্যবয়সী ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ফরারফবহফ এর সামাজিকীকরণ বলতে পারি।
অনিয়ম ও দুর্নীতি আমাদের বস্তুগত বা অবস্তুগত উৎপাদনকে পরিমাণগত ও গুনগত পর্যায়ে নিম্নগামী করে। এই নিম্নগামী প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই দাপ্তরিক সামাজিকীকরণ এর অভাব সঞ্জাত।
প্রতিটি সমাজই হাজারো প্রতিষ্ঠানের যোগে গঠিত, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজে আছে আইন-কানুন, রীতি-নীতি ইত্যাদি। সমাজের মানুষের আচরণ এগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির পরিচিতির কারণ হয়, তাহলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, সংবিধান ও সংবিধান থেকে উৎসারিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ম, রুলস ইত্যাদি এবং পদসোপানের ক্ষমতা, কর্তৃত্ত্ব ও নেতৃত্ত্বের গুণাবলী আত্মস্থ করা প্রয়োজন।
প্রতিটি অফিসেই থাকে আমলাতন্ত্র। ম্যাক্সওয়েবারের ভাষায় আজকের আধুনিক আমলাতন্ত্র হচ্ছে “জধঃরড়হধষ ইঁৎবধপৎধপু” বা যৌক্তিক আমলাতন্ত্র। প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগে রাজা বা রানীর ইচ্ছা পূরনের উপায় ছিলো আমলাতন্ত্র। এখন আমলাতন্ত্র আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এখন বিচারককেও বিচারকার্য পরিচালিত করতে হয়, আইনকে দেখে। বিচারক তাঁর রায়ে বলেন, অমুক অমুক ধারা অনুযায়ী আসামির অভিযোগ প্রমাণিত এবং বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী যে শাস্তি প্রাপ্য তাই আসামিকে দেয়া হলো। বিচারক আইনের দ্বারা নির্ধারিত। ঞৎধফরঃরড়হধষ বা অঁঃড়পৎধঃরপ ইঁৎবধঁপৎধপু তে এমন ছিলোনা। সেখানে শাসকের ইচ্ছা পূরণই ছিলো, বিচারের কার্যক্রম। আধুনিক শাসন ও প্রশাসনের মূল বিষয়ই হলো “ইচ্ছা নয়, আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রশাসন”। ব্যক্তি পছন্দ-অপছন্দের প্রশাসন ছিলো, ইউরোপে-মধ্যযুগে। অন্ধকার যুগ ছিলো, তখন। ইউরোপে পুঁজিবাদ বা শিল্পযুগের সূচনা জধঃরড়হধষ ইঁৎবধঁপৎধপু’র উদ্ভবের সাথে জড়িত। খধরংংবু ঋধরৎব অর্থনীতি ও যৌক্তিক আমলাতন্ত্রের উদ্ভবের সাথে জড়িত। মোদ্দাকথায়, আজকের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়ন যৌক্তিক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের উপর নির্ভরশীল। যেকোন দপ্তরে বা অফিসে এর কার্যক্রম ওই প্রশাসনের ফল নির্ধারণ করবে। যৌক্তিক আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যই হলো “নৈর্ব্যক্তিক প্রশাসন”। পছন্দ-অপছন্দ নয়, আইন ও নিয়ম-নীতির দ্বারা পরিচালিত হবে প্রশাসন।
আমাদের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে একথা সত্য, তবে প্রশাসন অনেক সময়ে যৌক্তিক আচরণ না করলে তা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হতে পারে। প্রশাসনের নি¤েœর দিকে নৈর্ব্যক্তিকতা এখনো যথেষ্ট নয়।
যদি পদায়িত দপ্তর প্রধান তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী অফিস পরিচালনা করতে চান, তখন তিনি হয়তো কোটারি (ঈড়ঃবৎরব) সৃষ্টি করতে পারেন।
এতে অফিস ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে এমন অবস্থা প্রায়ই সৃষ্টি হয় যা পত্রিকার পাতা থেকে দেখা যায়। একারণেই নিম্নের প্রশাসনিক পদায়নে দায়িত্ব গ্রহণের আগে, প্রতিষ্ঠানের দপ্তর পরিচালনার নিয়ম-কানুন জানা দরকার। নৈর্ব্যক্তিক প্রশাসন পরিচালনা না করলে, কোনস ভাবা উদ্যোগ শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তির ইচ্ছাপূরণের উপায় হয়। হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা এক্ষেত্রে ত্যাগ করতে হবে।
এইটি ব্যক্তিনিরপেক্ষ নেতৃত্ত্বের সবচেয়ে বড় গুণ। প্রতিটি অফিসপ্রধানকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। অফিস প্রধানকে যেমন প্রশাসনিক নিয়ম-নীতি জানতে হবে ঠিক তেমনি ঋরহধহপরধষ জঁষবং গুলো যথাযথ ঠিক রাখতে হবে। কত টাকা ঈধংয রহ ঐধহফ রাখা যায়, দপ্তরের কেনাকাটা থেকে শুরু করে খরচের খাতগুলো নিয়মনিষ্ঠ কিনা সেগুলোও খেয়াল রাখতে হয়। নিয়মসিদ্ধ হলে সকল সহকর্মীর উপকার করবার মানসিক অবস্থা থাকতে হবে। দপ্তরের সহকর্মীসহ সমস্ত কর্মকর্তা, কর্মচারীর সাথে সম্পর্ক সামাজিকীকরণের সাাথেও সম্পর্কিত। এর অভাবে এমনও হয়, সিনিয়র সহকর্মীদের চাকুরী থেকে বিদায় পর্যন্ত তিক্ততায় ভরপুর থাকে।
মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে থাকে সামাজিক সম্পর্কে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালটাকে যদি কর্মময় সামাজিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো যায়, তবে তাঁর ফল প্রকাশ পায়, সামাজিক ব্যবস্থায়। ব্যবস্থাপনায় অর্থ, সময় ও মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব খুব বেশি। আমাদের উন্নয়ন দৃশ্যমান, যদি এর সাথে যুক্ত হয় মানবিক সম্পর্কের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, তাহলে একটি সমৃদ্ধ সমাজ খুব নিকটেই বলে প্রতীয়মান হবে।

ড. ওবায়দুল করিম সমাজবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট