চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

৭ মার্চের ভাষণে ‘ইনশাআল্লাহ’র ব্যবহার

মাসউদুল কাদির

৯ মার্চ, ২০২০ | ৩:৩৬ পূর্বাহ্ণ

চতুর্দিকে হানাদারদের বেষ্টন ছিল। পুলিশ-গোয়েন্দা সবাই ছিল পাক সরকারের। ভীতি ছড়ানো রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির গর্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহসি এক ভাষণ দিয়েছিলেন। আঠারো মিনিটের বক্তব্যে পরের দিনগুলো কেমন যাবে এমন একটা দুর্দান্ত সাহসী বক্তব্য দিয়েছিলেনন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রাজধানীর রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বিকাল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে বক্তব্য শেষ করেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের একেবারে শেষে ইনশাআল্লাহ বলে আল্লাহর ওপর ভরসা করলেন তিনি। বক্তব্যটা ছিলো এমন- ‘প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোল। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সতর্ক বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সবধনের কথা ওঠে এসেছিল। তিনি পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের সব আয়োজন যেনো সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি সমগ্র জাতিকেই একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির বিষয়টিও পরিষ্কার করেন। সাত মার্চের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবে, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে, তবে কোন বাঙালি রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ইনশাআল্লাহ বলেই বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই ইনশাআল্লাহ এর আগে অসংখ্য নবী-রাসূলগণও প্রয়োজনে, কথায় কথায় বলেছিলেন। ইসলামের একটা নির্দেশনাও আছে এই ইনশাআল্লাহ বলার মধ্যে। আমরা সাধারণত আল হামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, মাশা আল্লাহ বলার ক্ষেত্রে প্রায়ই ভুল করে থাকি। অনেক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও ইসলামের এই পরিভাষাগুলো বলার সময় ভুল করে বসি। শিক্ষিতজনও। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চমৎকারভাবে ইনশাআল্লাহ শব্দের ব্যবহার করেছিলেন। আর এই ইনশাআল্লাহ ব্যবহার নয় কেবল, মহান আল্লাহ তাআলা এই শব্দ প্রয়োগের বাস্তবতাও দেখিয়েছেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের সময় ত্রিশলক্ষ মা-বোন-ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে আল্লাহতাআলা একটি দেশ আমাদের উপহার দিয়েছেন। নবীগণ ইনশাআল্লাহ ব্যবহার করেছেন, আল্লাহর নবী ইয়াকুব, শোয়াইব, খিজির ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম কথা বলার সময় ‘ইনশাআল্লাহ’ ব্যবহার করেছেন। বলেছেন হযরত মূসা আলাইহিস সালামও। হযরত খিজির আলাইহিস সালাম-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার দরখাস্ত করেন। তখন খিজির আলাইহিস সালাম জবাবে বলেন, আমি নিশ্চিত যে আমার সঙ্গে থাকার ধৈর্য আপনার নেই।’ এ কথার জবাবে মুসা আলাইহিস সালাম বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ’ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন। (সূরা কাহফ : আয়াত ৬৭-৬৯)। ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ (এমওডাব্লিউ) তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এমওডব্লিউ-তে এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। এটা নিশ্চয়ই সমগ্র বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশীদের বড় সম্মান।
বঙ্গবন্ধুর ইনশাআল্লাহ বলার মধ্যে যে আস্থা এবং বাস্তবতা ছিলো জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয় ছিল তা অবিস্মরণীয়। এই ইনশাআল্লাহর দ্যোতি মূলত ছড়িয়ে পড়েছিলো এ দেশের টগবগে যুবকদের হৃদয় অলিন্দে। তরুণদের হৃদয়ে ইনশাআল্লাহ আলোড়ন তুলেছিল। ঝড় তুলেছিল। ইনশাআল্লাহ মানে কী? একটি নিরহংকার মানুষের প্রতিচ্ছবি এই ইনশাআল্লাহ। কারণ, বান্দার যত ক্ষমতা সবই একজন মহান আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে হবে না। নিজের সব প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণাই ইনশাআল্লাহর উচ্চারণের মাধ্যমে হবে। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদিসে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন দোয়া না করে যে, হে আল্লাহ, তুমি চাইলে আমাকে ক্ষমা করো। তুমি চাইলে আমার প্রতি দয়া করো। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে দোয়া করো। কেননা আল্লাহ যা চান তা-ই করেন। তাকে বাধ্য করার মতো কেউ নেই।’ (বুখারি ও মুসলিম)

মাসউদুল কাদির ভাইস প্রেসিডেন্ট, আলেম মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম ফোরাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট