চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শান্তি ফিরবে কি আফগানিস্তানে তালেবান-মার্কিন ঐতিহাসিক চুক্তি

৪ মার্চ, ২০২০ | ১:৪৩ পূর্বাহ্ণ

শেষপর্যন্ত আফগানিস্তানে যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে শনিবার কাতারের রাজধানী দোহায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং শীর্ষ তালেবান নেতাদের উপস্থিতিতে তালেবান-মার্কিন ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলো। ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের প্রতিনিধিরাও এসময় উপস্থিত ছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১৩৫ দিনের মধ্যে বিদেশি সেনাদের প্রত্যাহার শুরু হবে এবং ১৪ মাসের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে আফগানিস্তানে মোতায়েন সব সেনা প্রত্যাহার করে নেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্ররা। অন্যদিকে আফগানিস্তানে নতুন কোনো হামলা চালাবে না এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতেও জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদাকে কোনো সহিংস তৎপরতা চালাতে দেবে না তালেবানরা। দেশ পরিচালনার পুরোভাগে থাকবে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন সরকার। আশা করা যায়, চুক্তি কার্যকর হলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ মসৃণ হবে। তবে চুক্তিতে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার শঙ্কায় এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ও আছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চুক্তি স্বাক্ষরের কিছুক্ষণ আগে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে আফগান ও মার্কিন সরকারের এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, চুক্তি স্বাক্ষরের সাড়ে চারমাসের মধ্যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সেনাসংখ্যা আট হাজার ৬০০ জনে নামিয়ে আনা হবে। বর্তমানে আফগানিস্তানে প্রায় ১৪ হাজার মার্কিন সেনাসহ প্রায় ১৭ হাজার বিদেশি সেনা রয়েছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আগামী ১৪ মাসের মধ্যে সব সেনা আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। তা ছাড়া আগামী ২৯ মের মধ্যে তালেবানদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তবে তালেবানরা শর্ত ভাঙলে এ চুক্তি বাতিল করতে কোনো দ্বিধা করবে না যুক্তরাষ্ট্র, চুক্তি স্বাক্ষরের পর এমন সতর্কবার্তা দিতে দেরি করেননি কাবুলে উপস্থিত মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার। আবার কারাগার থেকে পাঁচ হাজার তালেবান বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। অথচ শনিবার কাতারে তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শান্তিচুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল এই বন্দি মুক্তি। রবিবার রাজধানী কাবুলে সাংবাদিকদের আশরাফ গনি বলেন, ‘পাঁচ হাজার তালেবান বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি আফগানিস্তান সরকার দেয়নি।’ সঙ্গতকারণে তালেবান-মার্কিন স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিটি আফগানিস্তানের শান্তিপ্রিয় জনগণের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের মনে কিছুটা স্বস্থি দিলেও চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায় পেন্টাগন। এর পর থেকে আফগানিস্তানে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বধীন বাহিনী। তালেবানের সঙ্গে ১৮ বছরের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী দুই হাজারের বেশি সেনা নিহত হয়েছে। এ যুদ্ধে তিন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে বলে ধারণা করা হয়। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, এ যুদ্ধে ৩২ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, আফগানযুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৮ হাজার এবং বিরোধী পক্ষের ৪২ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। পাশাপাশি, মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর সাড়ে তিন হাজার সেনা নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার সৈন্যই যুক্তরাষ্ট্রের। এ যুদ্ধের একপর্যায়ে এক লাখের বেশি মার্কিন সেনার উপস্থিতি ঘটে। যুদ্ধে অংশ নেয় ৪০টির বেশি দেশের সেনারা। ক্ষয়ক্ষতির এই চিত্র বিবেচনায় নিয়ে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি পালনের অংশ হিসেবে তালেবানদের সঙ্গে দীর্ঘ ১৮ মাস ধরেই একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল ট্রাম্প প্রশাসন। গত শনিবার দোহায় দু’পক্ষের দায়িত্বশীলরাসহ বিশ্বের ৫০টি দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই চুক্তি সম্পন্ন হলো।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিকে ‘আলোর পথে এগিয়ে যাওয়া’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, এ চুক্তির মধ্য দিয়ে শান্তির সূচনা হলো। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসও বলেছেন, আফগানিস্তানে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে এ চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। আমরাও তালেবান-মার্কিন ঐতিহাসিক চুক্তিকে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করতে চাই, চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই আন্তরিক সদিচ্ছা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে। আমাদের বিশ^াস, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর আফগানিস্তানে আন্তঃআফগান আলোচনার পথ উন্মুক্ত হবে। সেখানে সব দলের মধ্যে আলোচনার মধ্যে রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণ ঘটবে, শান্তি হবে টেকসই। আফগানিস্তানকে পুনরায় শান্তি-সমৃদ্ধির দেশে পরিণত করতে সব পক্ষই কাজ করবে- এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট