চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা নদীরক্ষায় যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

রেজা মুজাম্মেল

৩ মার্চ, ২০২০ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। এটি দেশের জাতীয় সম্পদ। অর্থনৈতিক এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বিবেচনায় এটির গুরুত্ব অনন্য। কিন্তু বর্তমানে যথাযথ পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাব, মা-মাছ শিকার, অপরিকল্পিত স্লুইস গেইট নির্মাণ,
দখল, দূষণ, বর্জ্য ফেলা, বাঁক কাটা, অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন, ইঞ্জিন বোট চালানো, চাষাবাদের জমির কীটনাশক ফেলা, তামাক চাষের আগ্রাসনসহ নানাভাবেই চলছে মনুষ্যসৃষ্ট অত্যাচার। তাছাড়া স্থানীয় লোভাতুরদের শকুনি দৃষ্টি তো আছেই সব সময়। ফলে প্রাকৃতিক এ সম্পদটির গলা সব সময়ই টিপে ধরে রাখে একশ্রেনির মানুষরূপী নদীখেকোরা। শনৈঃ শনৈই এসব নদীখেকোদের রূদ্র রূপ দেখা যায়। তদুপরি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যখন হালদা নদীর মা মাছ থেকে রেণু তুলনামূলক কম পাওয়া যায়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে রেণু সংগ্রহে মহাবিপর্যয় ঘটে যায়। বিপর্যয়টি ঘটে কার্যত মনুষ্যসৃষ্ট অত্যাচারের কারণেই। প্রকৃতিকে বিরক্ত করার করুণ পরিণতি জাতি দেখেছিল সে বছর। পক্ষান্তরে নদীটি রক্ষণাবেক্ষণে প্রকৃত কর্তৃপক্ষের অভাবেও এমনটি হয় বলে ধারণা।

দুই. তবে আশার কথা হলো সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীতে সরকারিভাবে ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে হালদা নদী এলাকা সংশ্লিষ্ট এলাকায় এ ব্যাপারে করণীয় কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭ মতে, কোনো প্রাকৃতিক সম্পত্তিকে ঐতিহ্য ঘোষণার পূর্বে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের পরামর্শ গ্রহণ করে। খাগড়াছড়ির রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলা এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নদীতে মা-মাছ ধরা, জাল ফেলা, বালি উত্তোলন এবং দখল-দূষণ বন্ধ করাসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ করা হয়। তাছাড়া প্রকৃত জেলেদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হালদা নদীকে হেরিটেজ ঘোষণায় স্থানীয় পর্যায়ের সমন্বয় করছেন হাটহাজারী নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমীন। নদী রক্ষায় এটি সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।

তিন. একটি নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণার কিছু মাপকাঠি, বৈশিষ্ট্য থাকে। এসব বিবেচনায় হালদা নদীর সবগুলো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। হালদা নদীর উৎস, বিস্তার, অর্থনৈতিক অবদানসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে একমাত্র হালদাই দেশের জাতীয় নদীর স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। কারণ অন্যান্য নদীগুলোর দৈর্ঘ্য ও অর্থনৈতিক অবদান বিবেচনা করলেও সেইসব নদীর উৎস বাংলাদেশ নয়। ফলে নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। হালদা দেশের একমাত্র নদী, যা জাতীয় নদী হিসাবে সব শর্ত পূরণ করে। ফলে দেশের ৭৬১টি নদীর মধ্যে হালদা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নদী। অন্যদিকে, পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জাতীয় প্রতীক হিসাবে আছে, জাতীয় ফুল, জাতীয় গাছ, জাতীয় মাছ, জাতীয় পশু ইত্যাদি।
এসব প্রতীক সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় ঐতিহ্য-স্মারক বহন। পৃথিবীর নদীনির্ভর দেশগুলোতেও জাতীয় নদী আছে। নদীর আর্থিক অবদান, যোগাযোগ, পানি, মৎস্য ও কৃষিজ উৎপাদনে, পর্যটন ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে দুঃখজনক সত্য হলো, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, নদীকেন্দ্রীক অর্থনৈতিক দেশ, দেশের প্রধান চালিকা শক্তি নদীনির্ভর, তবুও দেশে কোনো নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়নি। অথচ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় নদী হলো গঙ্গা, পাকিস্তানের জাতীয় নদী সিন্ধু, মিশরের জাতীয় নদী নীল নদ।
তবে বিলম্বে হলেও হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষণা করা হচ্ছে।

চার. ঐতিহ্য, সম্পদ ও অর্থনৈতিক অবদানসহ নানা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে হালদা নদী দেশের জাতীয় মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্যের দাবিদার। বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে আছে- ক. এটি অদ্বিতীয় নদী। হালদা নদী বাংলাদেশের একমাত্র রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিগনি) প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এবং বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী। যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। খ. প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। বর্তমানে ইনব্রিডিং এর কারণে মাছের বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য হালদা নদীর এই প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক সংরক্ষণের বিকল্প নেই। গ. ঐতিহ্যবাহী হালদা নদী থেকে ডিম আহরণ, আহরিত ডিম থেকে রেণু উৎপাদন এবং পরিচর্যা প্রযুক্তি স্থানীয়দের সম্পূর্ণ নিজস্ব, স্বকীয়। স্মরণাতীতকাল থেকে ধর্মীয় অনুভূতি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সংমিশ্রণের এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিম আহরণ, আহরিত ডিম থেকে রেনু উৎপাদন করে আসছে। ঘ. আর্থিক অবদান। হালদা নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনন্য। হালদা থেকে আহরিত ডিম থেকে যে রেণু উৎপাদিত হয়, সেই রেণু প্রতি কেজির দাম প্রায় এক লাখ টাকা। এরপর এই রেণু থেকে অঙ্গুলি সমান পোনা উৎপন্ন হলে এর প্রতিটির দাম পড়ে ১০ টাকা। পূর্ণাঙ্গ মাছের বাজারমূল্য প্রতি কেজি মাত্র ১০০ টাকা হিসাব করে হয় ৮০০ কোটি টাকা। শতকরা ৪০ ভাগ ডিম নষ্ট হবে হিসাব ধরেই এটা করা হয়ে থাকে। তাই একক নদী হিসাবে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর অবদান তাৎপর্যবহ। ঙ. পরিবেশ।

বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলতঃ পরিবেশগত। বর্ষামৌসুমে নদীর পরিবেশগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে মা মাছ ডিম ছাড়তে আসে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক। চ. পানি সম্পদ। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের সুপেয় পানির প্রধান উৎস হালদা নদী। এ নদী থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে। এ নদীর পানিতে হেভি মেটালের পরিমাণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান থেকে কম হওয়ায় বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির উৎস হিসাবে হালদা নদীর পানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। (সুত্র : হালদা কেন জাতীয় নদী নয়, অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া)।
পাঁচ. হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হলে নদীটি বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব পাবে। নদীটি রক্ষণাবেক্ষণ ও দখল-দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ ত্বরান্বিত হবে। জাতীয় ঐতিহ্য হওয়ায় এটি নিয়ে নীতিমালা করার উদ্যোগ নেবে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। গঠন হবে একটি কার্যকর কমিটি। এ কমিটির মাধ্যমে নিয়মিত তদারকির আওতায় থাকবে। ফলে নদীটি রক্ষায় একটি কর্তৃপক্ষ হবে। সরকারের শুভ দৃষ্টির মধ্যে থাকলে প্রাকৃতিক এ সম্পদটির একটি রক্ষাকবচ তৈরি হবে। তাছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে হেরিটেজ হওয়ায় নদী রক্ষায় অতিরিক্ত সুবিধা তৈরি হবে। নদী রক্ষায় এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। অতএব, রক্ষা হোক হালদা নদীসহ সব নদী। অক্ষুণœ থাকুক প্রাকৃতিক সম্পদ। রক্ষা হোক পরিবেশ, প্রতিবেশ।

রেজা মুজাম্মেল গণমাধ্যমকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট