চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাদি.)

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৩ মে, ২০১৯ | ১:৩৫ পূর্বাহ্ণ

হযরত আয়িশা (রা.)। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর প্রিয়তম সহধর্মিনী। নবীজীর কথা কর্ম ও আদর্শের নিকটতম সাক্ষী এ মহীয়সী মহিলা। মহানবীর তিরোধানের পর ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য জীবন্ত কিংবদন্তী ছিলেন হযরত আয়িশা (রা)। সাহাবী পরবর্তী যুগের প্রখ্যাত তাবেঈ আতা ইবনে আবী রাবাহ (রহ.) বলেন, হযরত আয়িশা ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ বা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ, সবচেয়ে জানা ব্যক্তি এবং আমজনতার মধ্যে সুন্দর মতামতের অধিকারিনী (আল মুসতাদরিক)। হযরত আয়িশা নিজে বলতেন, আমি গর্বের জন্য নয়, বরং বাস্তব কথাই বলছি। আর তা হলো, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যার আর কাউকে দান করেন নি। যেমন, ফেরেশতা রাসূলুল্লাহকে স্বপ্নের মধ্যে আমার ছবি দেখিয়েছেন, আমার সাত বছরের বয়সে রাসূল আমাকে বিয়ে করেছেন, নয় বছর বয়সে আমি স্বামী গৃহে গমন করেছি, আমার নির্দোষিতা ঘোষণা করে কুরআন শরীফের আয়াত নাযিল হয়েছে, জিবরাঈল ফেরেশতাকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, আমারই কক্ষে নবীজীর কাছে ওহী নাযিল হয়েছে এবং তার কবর স্থাপিত হয়েছে ইত্যাদি। হযরত রাসূলে কারীম (স.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা জ্ঞানের অর্ধেকই আয়িশা হুমায়রা থেকে গ্রহণ কর।’ মহানবী যে প্রিয়তমা স্ত্রী সম্পর্কে উম্মতদেরকে জ্ঞান আহরণের এত উচ্চ তাগিদ দিয়েছেন আজ আমরা তার থেকে জ্ঞানের ফায়দা হাসিল তো দূরের কথা, তার সম্পর্কেও অনেক নারী-পুরুষের মোটামুটি ধারণা কম রয়েছে। হিজরী সনের শাওয়াল মাস। হযরত আয়িশার সাথে মহানবীর পবিত্র শাদী মোবারক সংঘটিত হয়েছিল। এদিক দিয়ে এ মাস নবীপত্নী আয়িশার বিভিন্ন স্মৃতি বিজড়িত। তাই সংগত কারণেই আজ এ মহীয়সী মহিলা সম্পর্কে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তার জীবনের কিছু চুম্বক আলোচনা।
এ মাসে আয়িশা (রা.) এর বিয়ের মাধ্যমে তৎকালীন আরবের বহু কুসংস্কার কুপ্রথার বিলোপ ঘটেছিল। তারা সকল প্রকার ভাই, এমন কি মুখে বলা ভাইয়ের মেয়েকেও বিয়ে করা বৈধ মনে করতো না। এ কারণে খাওলা (রা.) এর প্রস্তাব শুনে আয়িশার পিতা আবু বকর (রা.) বলে ওঠেন: এটা কি বৈধ? আয়িশা (রা.) তো রাসূল (স.) এর ভাতিজী। একথা রাসূলুল্লাহ (স.) এর কানে গেলে তিনি বলেন: আবু বকর আমার ইসলামী ভাই। তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে বৈধ।
আর একটি কুপ্রথা হলো, শাওয়াল মাসে তারা বিয়ে শাদী করতো না। অতীতে কোন এক শাওয়াল মাসে আরবে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। এ কারণে এ মাসটিকে তারা অশুভ বলে মনে করতো এবং এ মাসে তারা কোন বিয়ের অনুষ্ঠান করতো না। (তাবাকাত ৮/৬৩)। তৎকালীন আরবের কিছু লোকের এ বিশ্বাসও ছিল যে, এ মাসে নববধূকে ঘরে আনলে তাদের সম্পর্ক টেকে না। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এমন বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আয়িশা (রা.) এর এ বিয়ে কুঠারাঘাত করে। নববধূকে ঘরে আনার অনুষ্ঠানটি হয় দিনের বেলায়। এটাও ছিল প্রচলিত প্রথার বিপরীত। (ইবনে কাসির)।
আরেকটি প্রথা ছিল, দুলহানের আগে আগে তারা আগুন জ্বালাতো। নব দম্পতির প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হতো কোন মঞ্চে অথবা তাবুর অভ্যন্তরে। এই সকল কুপ্রথার মূলোৎপাটন ঘটে এই বিয়ের মাধ্যমে।
খুব অল্প বয়সে তিনি স্বামীর ঘরে উঠেছেন। তাই তখনও শিক্ষা দীক্ষা পার করে আসতে পারেন নি। কিন্তু সৌভাগ্য তার ঐশী জ্ঞানের অঝোর ধারা যেখানে প্রতিনিয়ত বর্ষিত হত সেখানেই এখন তার অবস্থান। শরীয়াতের মহান শিক্ষক ঘরেই ছিলেন। রাত দিন তার সাহচর্য লাভে ধন্য হতেন। প্রতিদিন মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহর (সা) তা’লিম ইরশাদের মজলিস বসতো। মসজিদের গা ঘেঁষেই ছিল হযরত ’আয়িশার (রা) হুজরা। এ কারণে রাসূল (সা) বাইরে লোকদের যে শিক্ষা দিতেন ’আয়িশা (রা) ঘরে বসেই তাতে শরীক থাকতেন। কখনো কথা দূরত্ব বা অন্য কোন কারণে বুঝতে না পারলে রাসূল (সা) ঘরে এলে জিজ্ঞেস করে বুঝে নিতেন। (মুসনাদ -৬/৭৭)। কখনো কখনো তিনি মসজিদের কাছাকাছি চলে যেতেন। রাসুল (সা) মহিলাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সপ্তাহের একটি দিন তাদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট করে নেন। দিবা-রাত্রি ইলম ও হিকমাত বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য বিষয়ের আলোচনা তার কানে আসতো। তার নিজের অভ্যাস ছিল, প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীন চিত্তে রাসুল (সা) এর নিকট উপস্থাপন করা। তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্ত হতেন না। একবার রাসুল (সা) বললেন:মান হুসিবা উযযিবা- কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেওয়া হবে সে শাস্তি ভোগ করবে। আয়িশা (রা) বলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা)! আল্লাহ তো বলেছেন, তার থেকে সহজ হিসাব নেওয়া হবে। রাসুল (সা) বললেন: এ হলো আমলের উপস্থাপন। কিন্তু যার আমলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে তার ধ্বংস অনিবার্য। (বুখারী: কিতাবুল ইলম)।
হযরত আয়িশা (রা) যখন পিতৃগৃহ থেকে বউ হয়ে যে ঘরে এসে ওঠেন তা কোন আলিশান অট্টালিকা ছিল না। মদীনার বনু নাজ্জার মহল্লার মসজিদে নববীর চার পাশে ছোট্ট ছোট্ট কিছু কাঁচা ঘর ছিল। তারই একটিতে তিনি ্্্এসে ওঠেন। ঘরটি ছিল মসজিদের পূর্বে। তার একটি দরজা ছিল পশ্চিম দিকে মসজিদের ভেতরে। ফলে, মসজিদ ঘরের আঙ্গিনায় পরিণত হয়। হযরত রাসূলে কারীম (সা) সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন । তিনি যখন মসজিদে ই’তিকাফ করতেন, মাথাটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন আর ’আয়িশা (রা) চুলে চিরুনি করে দিতেন । (বুখারী ঃ আল ইতিকাফ)। কখনো মসজিদে বসেই ঘরের মধ্যে হাত দিয়ে কোন কিছু আয়িশা (রা) নিকট থেকে চেয়ে নিতেন । (বুখারী ঃ কিতাবুল হায়য)।
ঘরটির প্রশস্ত ছিল ছয় হাতেরও বেশী । দেয়াল ছিল মাটির । খেজুর পাতা ও ডালের ছাদ ছিল । তার ্্্্্্্উপর বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কম্বল দেয়া হয়েছিল । এতটুকু উঁচু ছিল যে একজন মানুষ দাঁড়ালে তার হাতে ছাদের নাগাল পাওয়া যেত । এক পাল্লার একটি দরজা ছিল ; কিন্তু তা কখনো বন্ধ করার প্রয়োজন পড়ে নি । (বুখারী ঃ বাবুন নিসা; তাবাকাত -৮/৭১)। পর্দার জন্য দরজায় একটি কম্বল ঝুলানো থাকত। এই ঘরে লাগোয়া আর একটি ঘর ছিল যাকে মাসরাবা বলা হতো। একবার রাসূল (সা) স্ত্রীদের থেকে পৃথক থাকাকালে এক মাস এখানেই কাটান ।
ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল একটি খাট, একটি চাটাই, একটি বিছানা, একটি বালিশ, খোরমা খেজুর রাখার দুটি মটকা, পানির একটি পাত্র এবং পান করার একটি পেয়ালা। এর বেশী কিছু নয় । বিভিন্ন হাদীসে একাধিক স্থানে এই সব জিনিসের নাম এসেছে। যে ঘরটি ছিল দুনিয়া ও আখিরাতের সকল আলোর উৎস, সেই ঘরের বাসিন্দাদের রাতের বেলা একটি বাতি জ্বালানোর সামর্থ্য ছিল না। আয়িশা (রা.) বলেন: একাধারে প্রায় চল্লিশ রাত চলে যেত ঘরে কোন বাতি জ্বলতো না।
হযরত আয়িশার দ্বীনদারী ও স্বামীভক্তি ছিল অতুলনীয়। আল্লাহর ওয়াস্তে তার আমল ছিল অতি উচ্চাঙ্গের। একবার আরাফাতের দিন আয়িশা (রা.) রোযা রাখলেন। প্রচ- গরমের কারণে মাথায় পানির ছিটা দিচ্ছিলেন। একজন রোযা ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন: আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট শুনেছি যে, আরাফাতের দিন রোযা রাখলে সারা বছরের পাপ মোচন হয়ে যায়, তখন তা কিভাবে ভাঙ্গতে পারি ? (মুসনাদ ৬/ ১২৮)। অত্যন্ত কঠোরভাবে হজ্বের পাবন্দ ছিলেন তিনি। এমন বছর খুব কমই যেত, যাতে তিনি হজ্ব আদায় করতেন না। খলীফা উমর তার জীবনের শেষ পর্যায়ে হযরত উসমান ও আবদুর রহমান ইবন আওফকে (রা.) রাসূলুল্লাহর (স.) সহধর্মিনীদের সাথে হজ্বে পাঠান। হজ্বের সময় তাদের অবস্থানের স্থানসমূহ নির্দিষ্ট ছিল। প্রথমে ওয়াদী নামিরের শেষ প্রান্তে অবস্থান করতেন। সেখানে যখন মানুষের ভীড় হত, তখন তা থেকে একটু দূরে আ’রাফ নামক স্থানে তাবু করেন। কোনবার জাবালে সাবিরের পাদদেশে থাকতেন। মানুষ যখন আরাফা ছেড়ে চলতে শুরু করত, তখন তিনি ইফতার করতেন। (মুয়াত্তা সিয়ারু ইয়াওমি আরাফাহ)।
রাসূলুল্লাহ (স) কে চাশতের নামায পড়তে দেখে সারাজীবন তিনি এই নামায পড়েছেন। তিনি বলতেন, আমার পিতাও যদি কবর থেকে উঠে এসে আমাকে এ নামায পড়তে নিষেধ করেন, আমি তার কথা মানবো না। (মুসনাদ ৬/১৩৮)। একবার এক মহিলা আয়িশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলো : মেহেন্দী লাগানো কেমন ? জবাব দিলেন : আমার প্রিয়তমের মেহেন্দীর রং খুব পছন্দ ছিল, তবে গন্ধ পছন্দ ছিল না। হ্রাাম নয়। ইচ্ছে হলে তুমি লাগাতে প্রা।
হিজরী ১১ সনে রাসুলুল্লাহ (স.) এর বিদায় হজ্বের সফরসঙ্গী হন তিনি। হজ্ব ও উমারার নিয়ত করেন। কিন্তু স্বাভাবিক নারী-প্রকৃতির কারণে যথাসময়ে তাওয়াফ করতে পরলেন না। দারুণ কষ্ট পেলেন। কাঁদতে শুরু করলেন।
রাসূল (স.) বাহির থেকে এসে কাঁদতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন এবং তাকে করণীয় মাসআলা বাতলে দিলেন। তিনি ভাই আবদুর রহমান ইবন আবু বকর (রা.)কে সাথে নিয়ে অসমাপ্ত আবশ্যকীয় কাজ সমাপন করলেন। (বুখারী, কিতাবুল হজ্ব )। উল্লেখ্য বিদায় হজ্বে কমবেশী প্রায় এক লাখ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। উঁচু স্তরের সকল সাহাবী এর সফরে রাসূলুল্লাহর (স.) সফরসঙ্গী ছিলেন। এ সফরের যাবতীয় ঘটনা সকলের জানা থাকার কথা। হযরত আয়িশা (রা.)ও স্মৃতিতে ঘটনাটি ধরে রাখেন। ঠিক হজ্বের অনুষ্ঠানাদি আদায়কালীন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি ভীষণ কষ্ট পান। হযরত তাকে সান্ত¡না দেন এবং ‘তানঈম’ নামক স্থানে নতুন ইহরাম বেঁধে কা’বার তাওয়াফ করার নির্দেশ দেন। নবীপত্নী হযরত আয়িশা তানঈম এলাকায় নতুন করে ইহরাম পড়ে ওমরাহ পালন করেছিলেন বলে আজও লাখো লাখো হাজী সে এলাকা থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা পালন করেন। সৌদি সরকার এখানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশাল সুন্দর মসজিদ। এ মসজিদকে হযরত আয়িশার পুণ্য স্মৃতির কারণে মসজিদে আয়িশা বলা হয়। স্থানীয়রা তানঈম এবং ওমরা মসজিদও বলে।
হাফিজ ইবন কায়্যিম হযরত আয়িশার (রা) এ বর্ণনাটি নকল করার পর বলেছেন, হযরত আয়িশার (রা.) আমল ও হাদীস থেকে হজ্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মূলনীতি গৃহীত হয়েছে। যেমন, নারীদের ক্ষেত্রে শারীরিক বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে তাওয়াফুল কুদুম রহিত হয়ে যাবে। এ অবস্থায় হজ্বের পর উমরার নিয়্যত করা যায়িজ। নারীরা বিশেষ অবস্থায় শুধু কা’বার তাওয়াফ ছাড়া হজ্বের অন্যসব কাজ আদায় করতে পারবে। ‘তানঈম’ এলাকা হারামের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং হারামের বাইরে। উমরা এক বছরে এমন কি এক মাসেও দুই বার আদায় করা যায়। (যা’দুল মাআদ ১/২০৭, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা ৫/১৭০)।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট