চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পুণ্যের বীজ বপনের বার্তা নিয়ে এলো রজব চাঁদ

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

বছর ঘুরে পবিত্র রজব মাস আবার আমাদের সামনে উপস্থিত। ইসলাম ধর্মে রজব মাসের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী। একত: এ মাসের বহু ফজিলত ও মর্তবার কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত: এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল পবিত্র মি’রাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তৃতীয়ত: এ মাসের সাথে রমজানুল মুবারকের ব্যবধান মাঝখানে মাত্র এক মাস। কোন কোন বুজুর্গানে দ্বীন বলেছেন: রজব মাস খোদা তায়ালার রহমতের দরজায় হাজির হওয়ার মাস। যেমন- আমাদের প্রিয় নবী হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মি’রাজের মাধ্যমে আল্লাহপাকের দরবারে হাজির হয়েছিলেন। শা’বান হলো মহিমাময় ¯্রষ্টার নৈকট্য লাভের মাস আর রমযান প্রভুর সাথে মোলাকাত করার মাস।

তারা আরো বলেছেন: এ রজব মাস হলো পুণ্যের বীজ বপন করার মাস, শাবান বীজ ক্ষেতে পানি সিঞ্চনের আর রমযান মাস হলো পূণ্যের ক্ষেত হতে ফসল ও সাফল্য ঘরে তোলার।’ সুতরাং যে বা যারা রজব মাসে পুণ্যের বাগানে ক্ষেত-খামার করবেনা, শাবান মাসে ঈমান-আমল ও তাসবীহ-তাহলীলের নদ-নদী হতে তাতে পানি দিয়ে সতেজ করবেনা, রমযানে কিভাবে সে ব্যক্তি রহমতের ফসল ঘরে উঠানোর মানসিকতা পোষণ করতে পারে?’-(ইবনে নুবাতা)। তাই রজব মাস সম্পর্কে মুসলমানদের বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিৎ। আর তা নেই বলে আজ মুসলমানদের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও পবিত্র আত্মা গঠনের প্রয়াস প্রায়ই বিলোপ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ক্রমেই ঝুকে পড়ছে নগদপ্রাপ্তি ও মিথ্যা চাকচিক্যের দিকে। কুরআনুল কারীমে চারটি মাসকে ‘সম্মানিত’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনটি পাশাপাশি- জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মুহররম ও চতুর্থ রজব। এক হাদীসে মহানবী (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের বয়স হবে ৬০ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। আখেরি জামানার স্বল্প আয়ু সম্পন্ন মু’মিনদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে বছরে পাঁচটি বরকতপূর্ণ ইবাদতের রাত। তন্মধ্যে পহেলা রজব, অর্ধ-শা’বানের রাত, শবে কদর ও দুই ঈদের রজনী। পবিত্র মক্কা-মদীনা ও বায়তুল মোকাদ্দাসে নামায আদায় করা গেলে নামাজের সওয়াব বৃদ্ধি পায় সহস্র গুণে। যাদের জন্য উপরোক্ত তিন স্থানে নামায পড়ার সৌভাগ্য নসীব হয় না, তাদের জন্য বছরের এ নির্দিষ্ট পাঁচটি রাত আরো বেশী গুরুত্ববহ হয়ে উঠার কথা।
কারো কারো মতে, রজবের একটি নাম রজবে আছম’ বা বধির রজব। কেননা এ মাস আল্লাহর কাছে মানুষের শুধু সৎ কাজগুলো করার সাক্ষী হবে এবং বলবে ওহে আল্ল­াহ ! আপনার নবী (স.) আমার নাম রেখেছেন ‘বধির মাস’। হযরত সাওবান (রাদি.) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, যদি কোন ব্যক্তি এ মাসে একদিন রোযা রাখে এবং রাত জেগে ইবাদত করে তার আমলনামায় এক বছরের রোজা ও নামাযের সওয়াব লিখা হবে।’- (আল্লামা ইবনে নাবাতা)। আমরা যারা এ একদিন রোজা রাখার খেয়াল করি রজবের পহেলা তারিখেই রাখতে পারি। কারণ এ দিবস বছরের সেরা বরকতপূর্ণ পঞ্চদিবস(বা রজনীর) ১টি।
রজব মাসে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মি’রাজ শরীফ সংঘটিত হয়েছিল। মি’রাজ শরীফের মর্ম এই যে, ইসলাম ধর্মের মৌলিক ভিত্তি হলো আল্ল­াহ একজন আছেন। আল্ল­াহ তায়ালার বিচার সত্য। কর্মফল নেকী-বদীর ফলাফলের জন্য একটা দিন ধার্য আছে, একে আখিরাত বলে। ইহা সত্য। আল্ল­াহর রাসূল সত্য, এই তিনটি বিশ্বাসের উপরই ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি স্থাপিত। এখন প্রশ্ন আসে যে, এই তিনটি বিশ্বাস কি অন্ধ বিশ্বাস না কাল্পনিক যুক্তিভিত্তিক বিশ্বাস, না বাস্তব চাক্ষুষ দেখা বিশ্বাস? উত্তর এই যে, আল্ল­াহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের প্রিয় নবী কারীম (স.)-কে সপ্ত আকাশের উর্ধ্বে আরশের উপর পর্যন্ত সশরীরে তুলে নিয়ে সবকিছু দেখিয়ে দিয়েছেন। বেহেশ্ত, দোযখ, আরশ, কুরসী, লওহ, কলম; কোন পাপের কি শাস্তি, কোন নেকীর কি পুরস্কার, এবং স্বয়ং আল্ল­াহ তায়ালাকে পর্যন্ত আমাদের হুযুরে পুরনূর (স.) সচক্ষে দেখে এসেছেন। এমনভাবে দেখেছেন যে, কুরআন শরীফ সাক্ষ দিচ্ছে: মা যাগাল বাছারু অর্থাৎ তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি এবং সীমা লংঘনও করেনি। -(৫৩:১৭)।

যে দেখার মধ্যে এক বিন্দুও ব্যতিক্রম বা অতিক্রম হয়নি। এই চাক্ষুষ দেখার নামই মি’রাজ শরীফ। এরূপ মজবুত ভিত্তির উপর স্থাপিত পবিত্র ইসলাম ধর্মের ভিত্তি।
আল্লাহর হাবিব প্রিয় নবী করিম (সা.) বোরাকে আরোহণ করে নভোম-ল অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে তিনি বিভিন্ন অপরূপ দৃশ্য দেখে বিমোহিত হন। প্রথম আসমানে হযরত আদমের (আ.) সাথে সাক্ষাৎ হয়। আদম (আ.) হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে সাদর অভ্যর্থনা জানান। এ সময় গোটা নভোম-ল থেকে ধ্বনি উঠেঃ মারাহাবা, মারহাবা।
এক পর্যায়ে তিনি আশ্চর্যজনক কিছু বিষয় দেখলেন, কিছু লোকের ঠোঁট ও জিহ্বা কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন, কারা এরা ? বলা হলো এরা দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তা (ওয়ায়েজ); মুখে যখন যা আসতো তা বলতো এবং ফিৎনা লাগাতো। এক জায়গায় কিছু লোক নিজেদের দেহের গোশত কেটে কেটে খাচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা ? বলা হলো এরা অন্যদের গালিগালাজ করতো। তাদের পাশে আরো কিছু লোক দেখা গেল, যাদের নখ ছিল তামার এবং তা দিয়ে তারা মুখ ও বুক খামচাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? বলা হলো এরা সেই লোক, যারা মানুষের অনুপস্থিতিতে তাদের কুৎসা রটাতো ও মান ইজ্জতের উপর হামলা করতো। আরো কিছু লোক দেখলেন যাদের ঠোঁট দেখতে উটের মতো। এরা আগুন খাচ্ছিল, বললেন এরা কারা? বললো এরা ইয়াতিমের মাল আত্মসাৎ করতো। এরপর দেখলেন এমন কিছু লোক যাদের পেট খুব বড়, যা সাপে ভর্তি ছিল। যাতায়াতকারীরা এদের পদদলিত করে যেতো। কিন্তু তারা নিজেদের জায়গা থেকে নড়তে পারতো না। জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? বলা হলো এরা সুদখোর।
এরপর আরো কিছু লোক দৃষ্টিগোচর হলো। এদের একপাশে পবিত্র ও চর্বিযুক্ত গোশত রাখা ছিল অন্য দিকে রাখ ছিল বাসি পঁচা খাবার যা থেকে দুর্গন্ধ আসছিল। সেই ভালো গোশত রেখে দিয়ে তারা বাসি পঁচা গোশত খাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? বলা হলো, সেই নারী-পুরুষ যারা হালাল স্বামী ও হালাল স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও হারামভাবে নিজেদের চাহিদা মেটাতো।

এসব দৃশ্য দেখার এক পর্যায়ে নবী করীম (স.) এর সাথে এমন এক ফেরেশতার সাথে দেখা হলো, যিনি ছিলেন রুক্ষ মেজাজের। হযরত জানতে চাইলেন: এই ফেরেশতার এত রুক্ষ মেজাজের কারণ কি? জিব্রাইল (আ.) বললেন, এর হাসির কোন কারণ নেই। সেতো দোযখের একজন দারোগা । একথা শুনে তিনি দোযখের আরো দৃশ্য দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এরপর তিনি হঠাৎ করে সামনের পর্দা উঠিয়ে ধরলেন। আর অমনি দোযখের ভয়াবহ অবস্থা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

মি’রাজ শরীফকে যারা বিশ্বাস করেনা তাদের ঈমানের ভিত্তিই নড়বড়ে। অতএব প্রত্যেক বছর মি’রাজ শরীফের আলোচনা নতুনভাবে করে প্রত্যেক মুসলমানেরই ঈমানকে তাজা করা দরকার। মশহুর বর্ণনা মতে, -রজবের ২৬ তারিখ দিনগত ২৭ তারিখ পবিত্র মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাই আমরা যেন আসন্ন রজব মাসে ঈমান ও আমল পরিশুদ্ধ করার প্রয়াশ চালাই, বেশী বেশী করে ইবাদত বন্দেগী ও ইহতিসাব- আত্ম সমালোচনায় মনোযোগী হই। বিশেষ করে মসজিদে মসজিদে আসন্ন মিরাজুননবী দিবস উৎযাপনের প্রস্তুতি নিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফীক দিন।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট