চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে কয়েকদিন

রাজিয়া সুলতানা

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। ১৯৭২ সালের আগে এই দ্বীপ সিলন নামে পরিচিত ছিল। এর রাজধানী ও ঐতিহ্যবাহী বন্দর কলম্বো। শহরটি ব্যবসা, সম্মেলন ও ক্রীড়া ইভেন্টগুলির কেন্দ্র। ২কোটি জনসংখ্যার এই দেশে সাক্ষরতার হার ৯২% এবং ৮৩% মানুষ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সর্বোচ্চ সাক্ষর জনসংখ্যার একটি দেশ। ৭০% জনসংখ্যা বৌদ্ধধর্মাবল্বী। হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টান ধর্মাবল্বীও রয়েছে। শ্রীলঙ্কা চা, কফি, রাবার, দারুচিনি, নারিকেল উৎপাদন ও রফতানিতে বিখ্যাত।

আমরা শেভরনের এমডি, বড়ভাই ডা. হারুনের আমন্ত্রণে তাঁর ছেলে তাসাদ্দেকের বিয়ের জন্য কলম্বো যাই। ৪০ জনের একটি দল ২৯/০১/২০২০ তারিখ সকাল ৮.২০ মিনিটের বিমানে করে ঢাকা পৌঁছি। সবাই একসাথে এয়ারপোর্টের কার্যকলাপ শেষ করে ইবিএল লাউঞ্জে বসি।
এর পরের ফ্লাইট ঢাকা থেকে কলম্বো দুপুর ২টায়। এই লম্বা সময়ে আমরা খাওয়া দাওয়া, গল্প-আড্ডা, ছবি তোলা, নামাজসহ নিজেদের কাজ করে নেই। দুপুর ১টার পরে আমরা বোর্ডিং গেটে গিয়ে অন্যান্য কাজগুলি করে ফ্লাইটে উঠি। প্রায় ৪ঘণ্টা উড়ার পরে আমরা কলম্বো বন্দরনায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছি। কলম্বোর আবহাওয়া বাংলাদেশের চেয়ে গরম। সবাই একসাথে ইমিগ্রেশন করে, সিম ও ডলার একচেইঞ্জ করে ‘মুভ এন্ড পিক’ হোটেলে পৌঁছাতে প্রায় রাত ৮টার পর হয়। আমাদের জন্য ২টা বড় এসি বাস ৬দিনের জন্য ভাড়া করেন আমাদের হোস্ট হারুন ভাই। বাসগুলো আমাদের জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল। ‘মুভ এন্ড পিক’ হোটেলে আমাদের জন্য তাসা, তার নতুন বউ নাবিলা, নাবিলার আব্বা-আম্মা আপেক্ষা করছিলেন। করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধের জন্য এয়ারপোর্টে যাত্রী ছাড়া কেউ প্রবেশ নিষেধ ছিল।

আমরা সবার সাথে পরিচিত হয়ে রাতের খাবার জন্য কুইন্স ক্যাফেতে যাই। কুইন্স ক্যাফেতে আমাদের জন্য ছিল ল্যাম্ব বিরিয়ানীসহ রাজকীয় আয়োজন। মজাদার খাবার শেষে আমরা হোটেলে ফেরত আসি।
পরের দিন সকালের বাফেট নাস্তা খেয়ে আমরা বাসে অর্ধদিনের শহর ভ্রমণে বের হই। প্রচীনতম হোটেল, গঙ্গারাম মন্দির, লাল মসজিদ, স্বাধীনতা সৃতিসৌধ, গালে ফেইস গ্রীন, ২০০ বছরের পুরানো সিনামন গার্ডেন, কলম্বো পোর্ট গাড়িতে বসে দেখি। এ ভ্রমণে আমরা পূর্ব ও পশ্চিমের ঐতিহ্যবাহী বন্দর কলম্বোর ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানি। এরপর আমরা ‘কুইন্স ক্যাফেতে’ দুপুরের খাবার খেতে যাই। সকালের এত খাবার পর আবারও খেতে পারি।
সেদিন বিকাল ৪টায় আমার ছাত্রী ইউএসটিসির ১৬তম ব্যাচের নিরুকশী তার বাচ্চা নীহেশকে নিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে আসে। সে আমাদেরকে নিয়ে ‘লাকসালা’ নামের শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহ্যবাহী দোকানে নিয়ে য়ায়। সেখান থেকে আরজুর জন্য বুটিকের শার্ট, চাপাতা, দারুচিনি, নারিকেলের তৈরী চামচ ও সুভিনিয়র কিনি। এরপর নিরুকশী আমাদেরকে নিয়ে কফি খেতে যায়। সেদিন নিরুকশীর সাথে আমরা দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছি। আমরা উপহার আদান প্রদান করি। নিরুকশীকে ধন্যবাদ। সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের জন্য তাড়াতাড়ি হোটেলে ফেরত যাই। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা তাসার শ^শুড় ফারুখ ভাই এর দাওয়াতের জন্য রওনা হই। প্রায় ৪৫মিনিট বাসে চড়ে আমরা “সলিস হোটেলে” পৌঁিছ। বাসে যাওয়ার সময় আমরা গান বাজিয়ে, তালি দিয়ে আনন্দ করতে করতে যাই। ‘সলিস হোটেলে’ আমাদের অভর্থনা দেয়া হয়।

নাবিলার আত্মীয় স্বজনদের সাথে সবাই পরিচিত হই। এরমধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫জনের আর একটা দল সলিস হোটেলে আমাদের সাথে যোগ দেয়।। এ অনুষ্ঠানে ইউএসটিসির ১৮তম ব্যাচের ছাত্রী রিফকা কাদিরের সাথে দেখা হয়। পুরানো ছাত্রীর সাথে মিলিত হয়ে আমি খুশীতে বিহ্বল হয়ে পড়লাম। সে কলম্বোর এক হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ করছে। রাতের খাবারের পর আমরা গান-বাজনা ও নাচানাচি করে অনুষ্ঠানটিকে উপভোগযোগ্য, স্মরণীয় ও অধিক মজাদার করে তুলি।
৩১/০১/২০২০ তারিখ ছিল তাসাদ্দেক ও নাবিলার বিয়ের দিন। সকালের বাফেট নাস্তা খেয়ে আমরা ‘মুভ এন্ড পিক’ হোটেলের ছাদে ইনফিনিটি পুলে যাই। এরপর আরজুরা জুমার নামাজ পড়তে চলে যায়, আমি লক্ষীবৌদি ও মনোতোষ দাদা মিলে হোটেলের চারি পাশের এলাকাটা হেঁটে দেখতে যাই। হোটেলের কাছেই সিনেমা হল, শপিং মল ও কাঁচাবাজার ছিল।
কলম্বো শহর পরিষ্কার, লোকজন ভদ্র, রাস্তায় গাড়ীগুলি ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলছিল, যা আমাদের অভিভুত করেছিল। হোটেলে ফিরে জোহরের নামাজ পড়ে আমরা দুপুরের খাবার জন্য ‘কুইন্স ক্যাফেতে’ যাই। সন্ধ্যা ৬.৩০ হোটেল লবিতে সবাইকে মিলিত হতে অনুরোধ করা হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠান ৭টায় ‘মেরিনো বীচ হোটেলে’ শুরু হবে বলে আমাদের অবশ্যই সময় মেনে চলতে হবে। ‘মেরিনো বীচ হোটেলে’ পৌঁছাতে আমাদের ৭.৩০ মিনিট হয়ে গেল। আমাদের সবাইকে ওয়েলকাম গিফ্ট মধুর ছোট বোতল দিয়ে অভর্থনা দেয়া হয়। আমরা আমাদের নির্ধারিত টেবিলে গিয়ে বসি। কিছুক্ষণ পর নাবিলাকে নিয়ে তার বাবা স্টেজে গেলেন। নাবিলার পড়নে ছিল সাদা গাউন। সাথে ছিল ৬জন ব্রাইডস্মেইড ও বেহালার সুন্দর সুর। সবাই দাঁড়িয়ে বাবা আর মেয়েকে অভিবাদন জানান। এর কিছুক্ষণ পর আসে তাসাকে নিয়ে হারুন ভাই। তাদেরকে অভর্থনা জানান নাবিলার বাবা ও একজন মুরুব্বি। তাসার গায়ে ছিল নীল স্যুট ও গোলাপী টাই। তাসা এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরে ও দাদীকে সালাম করলে আমরা সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। তাসাকে নিয়ে হারুন ভাই ও নাবিলার বাবা স্টেজে যান। এরপর একজন মুরুব্বি পবিত্র কোরান থেকে তেলোয়াত ও মুনাজাত পরিচালনা করেন। সবাই দাঁড়িয়ে বর ও কন্যার জন্য দোয়া করেন, যা আমার খুবই পছন্দ হয়।
দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে সমস্ত মেহমানের অংশগ্রহন অনুষ্ঠানটিকে আরো এক ধাপ উপড়ে নিয়ে যায় ও স্মরণীয় করে রাখে। এরপর নাবিলার বাবার বক্তৃতা ছিল হৃদয়গ্রাহী ও হৃদয়স্পর্শী, যা আমার চোখ ভিজিয়ে দেয়। তাসা আর নাবিলার বক্তৃতা ছিল ধন্যবাদপূর্ণ, স্বীকৃতিমূলক, ও মঙ্গলকামী। নাবিলার বক্তৃতার সাথে আমরাও কেঁদেছিলাম। বক্তৃতার পর তাসা আর নাবিলা বিয়ের কেক কাটে ও নাচে। এরপর তাসার পক্ষ থেকে ডা. ইকবাল ভাই বক্তৃতা দেন। সব বক্তৃতার শেষে বিয়ের গান শুরু হয় আর খাওয়া-দাওয়াও শুরু হয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদেরকে বিয়ের কেক দেয়া হয়। খাওয়া-দাওয়া ছিল খুবই মজাদার ও রাজকীয়। এর মধ্যে সব সময় ছবি তোলা চলছিল। অন্য দেশে অন্যরকম বিয়ের অভিজ্ঞতা ছিল দুর্দান্ত, উপভোগযোগ্য, স্বচ্ছন্দ্যময়। ধন্যবাদ হারুন ভাইকে আমাদেরকে এরকম একটা স্মরণীয় উপহার দেয়ার জন্য।

০৩/০২/২০২০ ছিল বিদায় অনুষ্ঠান বা ফেয়ার ওয়েল ডিনার। আমরা মাঝে ২দিনের জন্য মালদ্বীপ ভ্রমণে যাই। ০৩ তারিখ ফেরত আসি। ফেয়ার ওয়েল ডিনার হয় রামাদা হোটেলে। এদুই দিন মালদ্বীপে সবাইকে আমি অনেক মিস্ করেছি। সবাই আমাকেও অনেক মিস করেছে। একয়দিনে সবার সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছিল যেন অনেক আপনজন। এরপর পাওয়ার পয়েন্টে তাসা আর নাবিলার পরিচয় ও বন্ধুত্ব নিয়ে আনন্দদায়ক স্লাইড শো দেখানো হয়।
পরের দিন ভোর ৩টায় দেশে রওনা হতে হবে বলে আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে হোটেলে ফেরত যাই। ভোর ৩.৫০ টার দিকে আমরা এয়ারপোর্টে রওনা হই দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে। তাসা ও নাবিলা এসে আমাদের বিদায় জানায়। বিদায় তোমাদের, ভালো থেকো, জীবনে সুখী হও।

রাজিয়া সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, প্যাথলজী বিভাগ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু
হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট