চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জ্ঞানের মেলা, প্রাণের মেলা, মুজিববর্ষের বইমেলা

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণের অগ্রদূত, টুঙ্গিপাড়ার মধুমতি নদীপাড়ের খোকা, পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালি জাতিসত্তার বর্তমান ও ভবিষ্যত ইতিহাসের অনিবার্য মহাপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। যার শ্বাস-প্রশ্বাসে বাংলাদেশ। যার কর্মকীর্তিই বাংলাদেশ। যার চেতনা-চিন্তায় বাংলাদেশ। যার জন্ম-মৃত্যুই বাংলাদেশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিব। ব্যক্তিসত্তার সাথে মিশে যাওয়া জাতিসত্তা, জাতিসত্তার সাথে নিবিড়ভাবে সংমিশ্রিত হওয়া ব্যক্তিসত্তা। এই মহান ব্যক্তির ব্যাপ্তিই বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের অনিবার্য, অনিরুদ্ধ, অবিসংবাদিত মহাপুরুষটি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালে জন্ম নিয়ে এই মহাপুরুষ তাঁর রক্ত¯্রােতে, সংবেদনশীলতায়, চেতনায়, অনুভূতিতে বাঙালিত্বকে ধারণ করে বর্বর পাকিস্তানিদের নির্যাতন, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার, অমানবিকতা ও অমানসিকতাকে পিছনে ফেলে বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তির মহানদূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বহু প্রত্যাশিত বাংলাদেশ নামের ভূখ-ের জন্ম দেন। হয়ে যান সমগ্র বাংলা ভূখ-ের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ-অঙ্গ।

জাতিসত্তা এবং জাতিগোষ্ঠীর এই অবিসংবাদিত প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিদাতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে উৎসর্গ করা চট্টগ্রামের একুশে বইমেলা, জ্ঞানমেলা, ‘মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত অমর একুশে বইমেলা, চট্টগ্রাম,’—মুজিববর্ষের অনন্যসাধারণ উপহার। চট্টগ্রামবাসীর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার অনুপম অর্ঘ্য।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ ও বাদের বিস্ফোরণে যে স্বাধীনতা, সে স্বাধীনতারই মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করা এই বইমেলা, প্রাণের মেলা। মায়ের ভাষার মাহাত্ম্য বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির চেয়ে বেশি আর কে বুঝে! বর্ণমালার রক্তাক্ত পথ ধরেই আমাদের মহান স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীন পথচলা।
স্বাধীনতা পরবর্তী ভিনদেশী ষড়যন্ত্রে অন্নসংকট, বস্ত্রসংকট, আবাসন ও খাদ্যসংকটের কোটি মানুষের দেশ আজ পৃথিবীতে স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে । ক্ষুধা মুক্তি, দারিদ্রবিমোচন, বস্ত্র- বাসস্থানের সংকটকে পিছনে ফেলে সামাজিক ও মানবিক প্রায় সব সূচকেই দেশটি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর রক্ত¯্রােতের উষ্ণপরশ ও তীক্ষ্ণ অদম্য গতিধারায় এগিয়ে যাওয়া অনিরুদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নজয়ী যাত্রা এদেশের কোটি মানুষের মন ও মননে স্থায়ী প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। স্বপ্ন আজ হাতের মুঠোয়। আমরা করছি জয়। আমরা করবো জয়।

আন্তর্জাতিক বৈপরীত্য আজ মিত্রতে পরিণত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সর্বোত্তম উত্তরাধিকার বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে, এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে স্বপ্নজয়ে প্রত্যয়ী করে তুলেছে। শিক্ষায়, কৃষিতে, ক্রীড়ায়, স্বাস্থ্যে, তথ্যপ্রযুক্তিতে, আন্তর্জাতিক দ্বিপক্ষীয় বিষয়-আশয়ে আমাদের দৃঢ়-দীপ্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
পঁয়তাল্লিশ বছর যাবত চেতনার মুজিব, আদর্শের মুজিব, প্রত্যয়ের মুজিব আজ এদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সব জায়গায় প্রেরণার মূল উৎস। হাজার জনমের প্রত্যাশার মুজিব শতজনমের মুজিববর্ষে এসে পুঞ্জিভূত হয়েছে বাঙালির মননে। মানুষের প্রত্যাশার আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছে চেতনার মুজিব। গণমানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাক দারুনভাবে কমে এসেছে। স্বাধীনতার চেতনাগুচ্ছ ফুটন্ত পুষ্পে বিকশিত হচ্ছে।
মুজিববর্ষের এই আনন্দঘন অনুষ্ঠানগুলো বাঙালির নিত্যকর্মে, তারুণ্যের স্বপ্নদর্শনে, গণমানুষের চেতনায় আনন্দ উচ্ছ্বাসের ঝড় তুলেছে। এ ঝড় মুজিবীয় চেতনাঝড়, এ ঝড়ের চালক মুজিবকন্যা। সমসাময়িক বিশ্বের অনন্যসাধারণ ক্যারিশমেটিক নেত্রী শেখ হাসিনা। অদম্য বাংলাদেশের অনিরুদ্ধ অগ্রযাত্রার মহান নেত্রী। ভাত-মাছের বাঙালিকে যিনি মুজিবের চেতনা ও আদর্শিক স্বপ্নের বাহনে যাত্রী করে ভাতমাছ কে ছাড়িয়ে বাঙালির, বাংলাদেশের মানুষের সমৃদ্ধির পুষ্টিকে, এদেশের মানুষের আত্মসম্মানকে অনেক উপরে তুলে এনেছেন। বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্তের যথাযোগ্য উত্তরাধিকার।

১৯৭২ সালে যে দেশটি থেকে শুধুমাত্র পাট, চা, চামড়া পৃথিবীর ২৫ টি দেশে রপ্তানি হতো, ২০২০ সালে এসে সেই দেশটিই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে পৃথিবীর ১৯৮টি দেশে প্রায় ৯০০ প্রকার পণ্য রপ্তানি করছে। ১৯৭২ সালের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যে দেশটির জাতীয় বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকায়। অর্থনীতির সক্ষমতা অর্জিত হচ্ছে। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার প্রশংসনীয় ভাবে কমিয়ে, শিক্ষার হার কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়িয়ে, মানুষের গড় আয়ুকে উপমহাদেশে অপরাপর দেশগুলোর শীর্ষে নিয়ে, মহিলাদের ক্ষমতায়ন করে, অসহায় বয়স্ক মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এনে সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছেন এই নেত্রী। এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে যাচ্ছেন।
অর্থনীতির বিদেশনির্ভরতা অনেকটাই কমে এসেছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে সালাম, বরকত, রফিকসহ ত্রিশলাখ শহীদের রক্ত¯œাত এই দেশটি মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে উঠে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নৌকায় ভর করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখে হাসি ফোটানোর এই নেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা। পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয়া নেত্রী। পরিবেশ ও মানবতার নেত্রী। নিপীড়িত মানুষের নেত্রী। পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থী সংকটকে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করার নেত্রী, আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপুষ্প প্রস্ফুটিত হবেই। আমাদের চেতনার শিকড়ে প্রোথিত আমাদের মায়ের ভাষা। যার সাথে নিবিড়ভাবে প্রোথিত-গ্রথিত আমাদের জাতীয়তাবোধ ও বাদ। যা মহাকালের স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়ে এনে দিয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। যে ভাষা আজ দেশে দেশে বিশ্ববাসীর মাতৃভাষার মর্যাদাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মানিত আসনে বসিয়েছে। সেই ভাষার মাসে আয়োজিত প্রাণের মেলা বইমেলা শতবর্ষী মুজিব বর্ষের মায়ায় ছায়ায় সিক্ত-পৃক্ত, অনুরক্ত, অভিষিক্ত হবে-এটাই প্রত্যাশা।
মুজিববর্ষে আনন্দঘন আবেশে মহিমান্বিত হোক প্রাণের মেলা, চট্টগ্রামের মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত অমর একুশে বইমেলা।

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলী গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট