চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ভয়ঙ্কর সেলফাইটিস

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সেলফি আসক্তি কত মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে তা বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। সেলফি আসক্তির কারণে বহুজনের জীবন চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অনেকের জীবনদীপও নিভে গেছে। চরম ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে, দুর্গম এলাকায়, হিংস্র- প্রাণীর মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে কিংবা গা ঘেষে, বহুতল ভবনের ছাদে, চলন্ত ট্রেন বা বাসের সামনে ও দরোজায় দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের চূড়ায় কিংবা বিপদসংকুল পয়েন্টে দাঁড়িয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ মুহূর্তেই পরপারে চলে যাওয়ার ঘটনা বারবার গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এ রকম অনেক ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে। সেলফি তুলতে গিয়ে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের জীবন সাঙ্গ হয়ে গেছে। দিনকয়েক আগেও দুপুরে কুড়িলে রেললাইনে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ গেছে ইমরান হোসেন নামে এক ছাত্রের। এ সময় আহত হয়েছে আল রাফি নামের তার এক সহপাঠী। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি প্রাণ যায় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর। সেলফি তোলার সময় তার হাত থেকে মোবাইল ফোনটি পুকুরে পড়ে যায়। আর সাঁতার না জানার কারণে সেটি তুলতে যেয়ে ডুবেই প্রাণ হারায় সে। সেলফি আসক্তি কারণে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই। এমন ভয়ঙ্কর শখে লাগাম টানতে না পারলে আরো কত মানুষ সেলফির বলি হবে, তা বলাই বাহুল্য।
সেলফি আসক্তি অনেকের কাছে এখন মরণনেশায় পরিণত হয়েছে। এই নেশা কিছু মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যদিও অল্প বয়সীদের মধ্যে এই নেশা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে, তবে বয়স্কজনদের মধ্যেও সেলফি আসক্তির বিস্তার ঘটছে ইদানিং। এটি চরম দুঃসংবাদই বটে। উল্লেখ্য, ডিজিটালযুগে বেশিরভাগ মানুষই স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে ব্যস্ত সময় কাটান। অন্যদের দৃস্টি আকর্ষণের জন্যে ফেসবুকে নানা ধরনের ছবি পোস্ট করেন। এ জন্যে অনেকে জনদৃষ্টি আকর্ষণকারী দুর্দান্ত ধরনের ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন দুই চারটা সেলফি তোলা এখন আর ফ্যাশন নয়, রুটিনের পরিণত হয়েছে অনেকের কাছে। কোনো অনুষ্টানে যোগদানের ছবিতো আছেই, মন খারাপ থেকে শুরু করে মন ভালো হওয়ার ছবিও পোস্ট করা হয় ফেসবুকে। নতুন জামা কেনা থেকে শুরু করে স্কুবা ড্রাইভিং সবখানেই সেলফি! এক সময় মেয়েরাই বেশি সেলফি আসক্ত ছিল। এখন ছেলেরাই বেশি সেলফি আসক্তিতে আক্রান্ত হচ্ছে। মূলত এক ধরনের অবসেসিভ ডিসঅর্ডারের জেরেই এই সেলফি তোলেন মানুষ এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যে, বিপজ্জনক সেলফি তোলা থেকেও বিরত হচ্ছে না মানুষ। তাতে প্রাণও যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, বিজ্ঞানীরা এই সেলফি তোলার প্রবণতাকে অসুস্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। সম্প্রতি আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের একদল গবেষক তাদের গবেষণা শেষে প্রকাশ করেছে, সেলফি তোলা একটি মানসিক রোগ। এ গবেষক দল সেলফিতে আক্রান্ত হওয়া রোগের নাম দিয়েছেন সেলফাইটিস। সেলফি তোলা আর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। যারা সেলফি তোলে তারা মূলত এ সেলফিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্য এক ধরনের পাগলামি করতে থাকেন। গবেষকরা আরও উল্লেখ করেন, এ সেলফাইটিস রোগের তিনটি ধাপ। ধাপগুলো হলো- ক) বর্ডার লাইন সেলফাইটিস। এ ধাপে আক্রান্তরা দিনে অন্তত তিনটি সেলফি তুলবে এবং তা নিজের কাছেই রেখে দেবে। কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে না। খ) একিউট সেলফাইটিস। এ ধাপে আক্রান্তরা দিনে অন্তত তিনটি সেলফি তুলবে এবং তিনটি ছবিই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে। ঘ) ক্রনিক সেলফাইটিস। এ ধাপে আক্রান্তরা সারা দিনে নিয়ন্ত্রণহীন তাড়না বা ইচ্ছা থেকে বিরামহীনভাবে যখন তখন সেলফি তুলবে এবং দিনে অন্তত ছয়টি বা এর বেশি সেলফি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা খুব বেশি সেলফি তোলে তারা সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় প্রকাশ করে। সেলফিতে আক্রান্তদের বেশিরভাগই কর্মজীবনে ও ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় এবং সাধারণদের চেয়ে তাদের কনফিডেন্ট লেভেলও কম থাকে। তাই তারা অনেক সময় হতাশা বা মেন্টাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন। অস্ট্রেলীয় একদল গবেষকের মতে, সেলফি তোলার এই রোগের রোগীরা শুধু সেলফি তুলেই ক্ষান্ত হন না, তারা তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার না করা পর্যন্ত স্বস্তি পান না। তারা তাদের ছবিতে ভার্চুয়াল বন্ধুদের মন্তব্যও আশা করেন। আর এই মন্তব্যের সূত্র ধরে তারা নিজেদের বিচার করা শুরু করলেই তা ‘ক্রনিক সেলফাইটিস’-এ রূপ নেয়।
আমরা মনে করি, এই ভয়ানক রোগের বিস্তার রোধে এখনই জোরালো সচেতনতা কর্মসূচি দরকার। এ ব্যাপারে সমাজের সচেতন ব্যাক্তিবর্গ এবং সামাজিক সংগঠনগুলো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। নিজের প্রতি যত্নবান হলে, পাশাপাশি ভার্চুয়াল জীবনের বাইরের সামাজিক জীবনে সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি হলে, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণবন্ত আড্ডার আয়োজন থাকলে এ ধরনের সমস্যা অনেটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট