চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রাত্যাহিক জীবনে বাংলার ব্যবহার

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

আমরা যখন কোন সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশে একত্রিত হই তখন দেখা যায়, অনেকেই বাংলাকে এমনভাবে উচ্চারণ করছে যেন বাংলাতেও পড়ে না আবার ইংরেজিতেও পড়ে না। আড়ং এ কাপড় কিনতে গেলে একজন সেলস গার্ল মসলিন শব্দটি বার বার মসলিন বলছিল। আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে কয়েক বার শব্দটি শুনতে তাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম। চারবারের সময় মেয়েটি আমাকে বলল, বুঝলেন না এটা হচ্ছে মুসলিন কাপড়। ফ্যাশন করে কথা বলতে গিয়ে মুসলিন কাপড় হয়ে গেল মাসলিন। এভাবে আরেকবার ফ্যাশন করে আমার এক নিকট আত্মীয় বক্সকে বাক্স বলছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, বাক্স কি? সে বলল, বাক্স আরকি? বাক্স অর্থ্যাৎ বক্স, প্যাকেট চিনেন না। এভাবে নিজের সামনে ভাষার এমন অপব্যবহারে নিজের ভাষাই হারিয়ে ফেলি। তখন চুপ করে নিজেদের অবস্থান যাচাই করি।
সেই ছোটকাল থেকে দেখে এসেছি শহীদ মিনারের পাদদেশে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে সেই সকাল থেকেই ফুল হাতে খালি পায়ে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন¯্রােত।
কখনো কখনো নিজেও সেই ¯্রােতের সাথে একাত্ম হতাম। এখনো দেখি স্কুলপড়ুয়া ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা খালি পায়ে শহীদ মিনারে যায়। তাদের হাতে থাকে ফুল, পাতা, পতাকা। বিভিন্ন স্কুলের ড্রেস বিভিন্ন রংয়ের হয়ে থাকে। কিন্ত সেই ছেলে-মেয়েদের মনের রং কিন্তু সাদা-কালোতে প্রতিবাদী থাকে। আর যারা বড় থাকে তারা সাদা-কালো রংয়ের পোষাকে শহীদ মিনারে যায়। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের অনেকেই আছে যারা ২১ ফেব্রুয়ারিতে লাল অথবা কড়া রংয়ের পোষাকে শহীদ মিনারে যায়। হয়ত কর্তব্যের জন্যই শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। কিন্ত আসলেই কি তারা বাংলা-বাঙালী-বাংলাদেশকে মেনে নিতে পেরেছে? শহীদ মিনারের কথা বলতে হলে আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের সম্মানিত প্রবাসী ও অভিবাসিরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই শহীদ মিনার বানিয়েছে। হয়ত ইট-পাথরের বিশাল আকারের শহীদ মিনার বানাতে পারে নাই, তবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে মাটির তৈরী, কাগজের তৈরী, কাটের তৈরী, ককসিটের তৈরী, কাপড়ের তৈরী শহীদ মিনারগুলো আমাদের গর্ব।
মাতৃভাষাতেই আমাদের সকলের সাথে কথোপথন সহজ হয়। ফলে জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মসম্পাদন ও যোগাযোগ আপন গতিতে চলতে থাকে। এই সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ রয়েছে, ‘‘তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাব প্রকাশ করতে (ভাষা) শিখিয়েছেন।’’নিজেদের জানা-অজানা, ধ্যাণ-ধারণা অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিতে প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আর মাতৃভাষাতেই সকল প্রকার সহজ ও কঠিন মনোভাব প্রকাশ করা যতটুকু সহজ হয় অন্য ভাষাতে তার চেয়ে অনেক বেশী কঠিন। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক উপজাতি বসবাস করছে। তারা শুদ্ধ ও সহজাতভাবে বাংলা ভাষাতেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেনা বলেই তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাদের অনেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে। কিন্তু ভাষার কারণে আমাদের সাথে ওদের দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে। তাই বর্তমান সরকার তাদের জন্য তাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতে বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। সামগ্রীক উন্নয়নের জন্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উপজাতীয়দেরকে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান করতে পারলে তারাও এদেশে উন্নয়নের ধারায় বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিয়ের নিমন্ত্রপত্র অথবা যে কোন অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রের ভাষা নিয়ে অনেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আজকাল নিমন্ত্রণ দেন ইংরেজিতে, নাহলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে মান-সম্মানে লাগে। অথচ যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হবে তারা কতটুকু ইংরেজিতে করা সেই দাওয়াত পত্রটি বুঝতে পারবেন তা অনেকেই বুঝে না। পারিবারিক ও সামাজিক দাওয়াত পত্রটি যদি বাংলায় দেওয়া হয় তাহলে সকলের কাছেই বোধগম্য হতে পারে। আর ইংরেজিতে করা দাওয়াত পত্রটি সীমিত কয়েকজন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। তবু আজকাল ইংরেজিতে দাওয়াতপত্র দেওয়ার রীতি বেশী প্রাধান্য পাচ্ছে। রাস্তা-ঘাটে চলার পথে অধিকাংশ অফিস-আদালত-দোকান-পাট-সংস্থার নাম ইংরেজিতে দেখা যায়। বর্তমানে সরকার বারবার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচায় এনেছেন এবং বাংলা শব্দ ব্যবহারে তাগিদ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্যাকরণের সংজ্ঞা অনুযায়ী মনের ভাষা প্রকাশের জন্য ভাষাকে শুদ্ধভাবে জানতে হবে। আমরা যদি মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করতে চাই তাহলে অবশ্যই বাংলা ব্যাকরণ জানতে হবে। আর বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলা ভাষাকে শুদ্ধ ও সঠিকভাবে আয়ত্ব করা। মনের ভাব প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সঠিকভাবে যোগাযোগ করা। নিজের উন্নয়নের জন্যে, পরিবারের উন্নয়নের জন্য, সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যাপক উন্নয়নের জন্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষার কোন বিকল্প নেই। যারা কথা বলতে পারেনা তারাও ইশারাতেই যোগাযোগ করে থাকে। বিকৃত ও দূষিত বাংলা ব্যবহারকে পরিহার করে শুদ্ধ ও সঠিক উপায়ে বাংলা চর্চা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ আমাদের সবাইকে আরো বিকশিত করতে সহায় হবে। উন্নয়নের মাপকাঠি হচ্ছে শুদ্ধ বাংলার প্রয়োগ। অনেকেই ভাষাকে ভাষা বলতে গিয়ে বাসা বলেন। আবার ভাষণ বলতে বাসন বলেন। এক্ষেত্রে সকলকে সচেতনও সচেষ্ঠ হতে হবে।
আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে যেভাবে হিন্দি বুঝে সেভাবে শুদ্ধ বাংলা হয়ত বুঝে না। তাদের আঞ্চলিক ভাষায় তারা বেশ পারদর্শি। কিন্তু যেখানে শুদ্ধভাবে বাংলা বোঝেনা, বলতে পারেনা, সেখানে তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে হিন্দিতে কথা বলে। আর যদি বাংলিশ ও ইংলিশের কথাবলি তাহলে বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা উল্লেখ করতে হয়, আধুনিক প্রজন্ম ও উচ্চশিক্ষিতের অনেকেই বাংলিশে যোগাযোগ চালিয়ে যায়। অথচ একটু চেষ্টা করলেই সুন্দর বাংলা অথবা ইংলিশে যোগযাযোগ করতে পারে। আমাদের অনিহা ও চেষ্টার অভাবে আমাদের বাংলা ভাষাকে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য ১৬ ডিসেম্ভর মহান বিজয় দিবসে গলফ ক্লাবের অনুষ্ঠানে ইংরেজিতে উপস্থাপন করার বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক জানি না। তবে ওখানে উপস্থিত সবাই ভাল বাংলা জানে। আবার অনেকেই ইংরেজিতেও অনেক পারদর্শী। তুলনামূলকভাবে বাংলায় দক্ষ অতিথিদের সংখ্যা বেশী।
অথচ অনুষ্ঠান সঞ্চালনের সময় ইংরেজি ব্যবহার করা হয় আর অনুষ্ঠানের নাচ-গান সবই বাংলা। গলপ ক্লাব কোন সাধারণ ক্লাব নয়। বাংলা-বাংলিশ-ইংলিশ ব্যবহারে অভিভাকদের অনেক বেশী সচেতন হতে হবে। সত্যিকারের শিক্ষিত হতে হলে বাংলাতে যেমন পারদর্শী হতে হবে তেমনি ইংরেজিতেও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাছাড়া আমাদের বাংলা নববর্ষের অনেক অনুষ্ঠানে ইংরেজি ও হিন্দি-গান শুনা যায়। বাংলা নববর্ষের গান হওয়া উচিত আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাংলা। সোনালি দিনের আধুনিক বাংলা গানগুলো নতুন প্রজন্মকে চেনাতে আরো বেশী পরিবেশন করা উচিৎ।

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট