চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চাই সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ পর্যটন খাতের অপার সম্ভাবনা

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশ পর্যটনতীর্থ হিসেবে সারাবিশ্বেই খ্যাত হয়ে আসছে। পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকতসমৃদ্ধ পর্যটননগরী কক্সবাজার, ইতিহাসের নানা গুরত্বপূর্ণ স্মারক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার চট্টগ্রাম, নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা ছোট-বড় পাহাড়-অরণ্যের সবুজগালিচা আচ্ছাদিত এবং আদিবাসী সংস্কৃতির তীর্থভূমি পার্বত্যচট্টগ্রাম, তিনশত ষাট আউলিয়ার দেশ সিলেট, বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার বৌদ্ধবিহার, ঢাকার লালবাগের কেল্লা, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, মোগল পাঠানযুগে নির্মিত ঐতিহাসিক মসজিদ, ঈদগাহসহ নানা নিদর্শন, প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, মাধবকু-ের ঝরণা, রাতারগুল পানিতে ভাসমান বন, কুয়াকাটাসহ দেশে অসংখ্য পর্যটনস্পট রয়েছে। এটি আমাদের জন্যে সুখবরই বটে। তবে, পর্যটনশিল্পের বিকাশে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ থাকলে পর্যটনশিল্পকে জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ করা যেতো। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ব্যাপক হারে পর্যটন আকর্ষণের সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এখনও অবশ্য সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। সরকার অগ্রাধিকার খাত গণ্য করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ পর্যটকদের স্বর্গভূমি বিবেচিত হবে, সন্দেহ নেই।

উল্লেখ্য, বিদেশি পর্যটকদের একেকজন কয়েক হাজার মার্কিন ডলার করে খরচ করে থাকেন। এ অবস্থায়ও পর্যটন থেকে এখন গড়পড়তা আয় হয় বার্ষিক সাড়ে পাঁচ শ কোটি টাকার বেশি। ৫০ লাখের বেশি দেশীয় পর্যটক প্রতি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে থাকেন। বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাও কম নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যটকের এই সংখ্যা শতগুণ বাড়ানো যাবে, যদি নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণ, থাকা-খাওয়ার নিরাপদ ও মানসম্মত ব্যবস্থা, পর্যটনস্পটগুলোর উন্নয়ন ও সর্বাধিক নিরাপদ রাখার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং প্রশিক্ষিত পর্যটক গাইড নিয়োগ করা, দেশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা মুক্ত রাখা, পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করাসহ নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশ সহজেই পর্যটক আকর্ষক দেশের তালিকায় শীর্ষ পর্যায়ে উঠে যাবে। প্রসঙ্গত, দেশের পর্যটনসম্ভাবনাকে আমলে নিয়ে সরকার ২০১৬ খ্রিস্টাব্দকে পর্যটনবর্ষ ঘোষণা করেছিল। বৌদ্ধধর্মীয় স্থানে পর্যটক আকর্ষণের জন্যে কর্মসূচিও গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানে পর্যটনের প্রসার ঘটাতেই মূলত এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতœতত্ত্ববিদ ও পর্যটন গবেষকেরা বলছেন, পরিকল্পনামাফিক এগোলে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের পর্যটন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হয়ে উঠবে দেশের পর্যটনের আয়ের প্রধান খাত। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান থাকলেও এ কথা বিশ্বব্যাপী এক প্রকার অজানাই ছিল। পাশের দেশ ভারতের দুটি রাজ্য উত্তর প্রদেশ ও বিহার, নেপালের লুম্বিনী (গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান) এবং মিয়ানমারে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৫০ লাখ পর্যটক বৌদ্ধধর্মীয় স্থান পর্যটনে আসে। অথচ বাংলাদেশে এ সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়ায় না। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বৌদ্ধধর্মীয় সংগঠন এবং বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলোর হিসাবে, বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যসমৃদ্ধ স্থান আছে পাঁচ শতাধিক। কিন্তু এশিয়াজুড়ে বৌদ্ধ ঐতিহ্য পর্যটনের বিপুল বাজার থেকে বাংলাদেশ একেবারে বিচ্ছিন্ন। অথচ কুমিল্লার ময়নামতির শালবন মহাবিহার থেকে শুরু করে নওগাঁর পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার বা মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে বগুড়ার বাসুবিহার, বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্য ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে। সোমপুর বিহার ছিল পাল আমলের উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র।

বজ্রযোগিনী গ্রাম গৌতম বুদ্ধের পর বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে বড় প্রচারক অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান। তাঁর হাত ধরেই বৌদ্ধ ধর্ম তিব্বত থেকে চীন ও জাপানে গেছে। আর ভাসুবিহারে গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং এসেছিলেন, এর ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের হিসাব অনুযায়ী, কুমিল্লার শালবন বিহারে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য ৩০টি বৌদ্ধবিহার। এ পর্যন্ত এর মধ্যে কেবল সাতটি বিহার খনন করা সম্ভব হয়েছে। একটি নগরে এতগুলো শিক্ষাকেন্দ্র বিশ্বের আরও কোথাও নেই। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের নানা প্রান্তের সন্ধিৎসু পর্যটকরা ছুটে আসবেন এসব স্থানে। একই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের ক্ষেত্রেও। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে পাশাপাশি বাংলাদেশ হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দেশ। এদেশে ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরপুর। এসব নিদর্শনের সুরক্ষা, উন্নয়নের পাশাপাশি চিত্রও তুলে ধরতে হবে পর্যটকদের সামনে। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে পর্যটন খাত থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করা যাবে। কিন্তু এ বিষয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপের অভাবে কাক্সিক্ষত ফল আসছে না।

এখন বিশ্বময় একুশ শতককে পর্যটনশিল্পের স্বর্ণসম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে পর্যটনকে জাতীয় আয়ের প্রধান খাত হিসেবে গ্রহণ করেছে। পশ্চিমাবিশ্ব তো বটেই, এশিয়ায় চীন, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের অনেক দেশে পর্যটনখাত আয়ের একটি বড় উৎস। বাংলাদেশও সুচিন্তিত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট