চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কি অবহেলিতই থাকবে?

রেজা মোজাম্মেল

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষদের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। এর পর পরই চট্টগ্রামে সরকারি দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল হাসপাতাল। যোগাযোগ বিবেচনায় হাসপাতালটির ভৌগোলিক অবস্থান ও বর্তমান অবকাঠামো মূল্যায়নে যথেষ্ট ইতিবাচক অবস্থানে আছে। চট্টগ্রাম নগরের প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লা এলাকায় এটির অবস্থান হওয়ায় যোগাযোগ অনেকটা সহজ। আর চিকিৎসা ব্যয়ও অত্যন্ত কম। নামমাত্র টাকায় বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ এবং অন্তর্বিভাগে সেবা পাওয়া যায়। দুর্মূল্যের বাজারের এই সময়ে কম টাকায় সেবা অনেক বড় একটি ব্যাপার।

কিন্তু প্রশ্নটা হলো, সরকারি এ সেবা প্রতিষ্ঠানটি কি জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম? প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী সেবা নিতে আসছেন, তারা কি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন? বহির্বিভাগে টিকিট কেটে কি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাগাল পাচ্ছেন? জরুরি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক কি রোগীকে আন্তরিকতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করছেন? অন্তর্বিভাগে ভর্তি থাকা রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা- ওষুধ, রোগ নির্ণয়, খাবার এবং সার্জারি ও গাইনি বিভাগের রোগীরা কি যথাসময়ে অপারেশনের সুযোগ পাচ্ছেন? অন্তর্বিভাগের রোগীরা কি বিশেষ জরুরি মুহূর্তে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় গাইনি, শিশু ও মেডিসিন বিভাগের রোগীদের করুণ আর্থি এবং হাহাকার কি কেউ শুনতে পান? কারো কি দেখার সুযোগ হয়েছে- একজন নবজাতক অথবা একজন এক-দুই মাস বয়সী শিশুর মাথা কিংবা হাতে স্যালাইন পুশ করা এবং নাকে অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় মা-বাবার দৌঁড়াদৌঁড়ির করুণ দৃশ্য?
একজন মা-বাবার জন্য পৃথিবীতে এর চেয়ে কঠিন এবং করুণ মুহূর্ত আর আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু নানা সংকট-সমস্যার আবর্তে থাকা এ হাসপাতালটিতে এমন চিত্রও দেখা যায়। সন্তান সম্ভবা প্রসূতি অথবা শিশু রোগীকে সংকটাপন্ন অবস্থায় গভীর রাতে চমেক হাসপাতালে পাঠানোর দৃষ্টান্ত মোটেও হাতেগুণা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এমন চিত্র ঘটেই চলেছে।

দুই. সরকারি প্রতিষ্ঠানে সমস্যা-সংকট আছে। রাতারাতি এ সব সমস্যা নিরসন সম্ভবও নয়। তাছাড়া, দ্রুত আকাশচুম্বী কিছু প্রত্যাশা করাটাও বাতুলতা। এ হাসপাতালে জনবল ও চিকিৎসা উপকরণ সংকট দীর্ঘদিনের। দেশের প্রতিটি সেবাকেন্দ্রেরই প্রায় অভিন্ন চিত্র। নানা বাস্তবতায় এটি স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু বিদ্যমান যা সম্বল আছে তা দিয়ে কি রোগীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায় না? একটু কি আন্তরিক হওয়া যায় না? অবশ্যই যায়। এর জন্য দরকার কেবল- আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, সেবা দেওয়ার মানসিকতা এবং রোগীর প্রতি মমত্ববোধ।
একজন রোগী যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান, তখন অনেক রোগীর কাছে চিকিৎসকের আন্তরিকতা, মমত্ববোধ, এতটুকুন ভাল ব্যবহার ওষুধের চেয়েও মূখ্য হয়ে যায়। ওই জরুরি মুহূর্তে রোগীর কাছে ওষুধের চেয়ে চিকিৎসকের আন্তরিকতা অনেক বেশি প্রত্যাশিত। তখন কিন্তু ওষুধ, চিকিৎসা উপকরণ কিংবা হাসপাতালের অন্যান্য কোনো কিছুই রোগীকে সান্ত¡না দিতে পারে না। পারে কেবল একজন চিকিৎসকের ভাল ব্যবহার।
তিন. ১৯০১ সালে ১০একর জায়গায় ৮০ শয্যার জনবল ও অবকাঠামো নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় জেনারেল হাসপাতাল। ২০০৩ সালে পূর্বের জনবল ঠিক রেখেই হাসপাতালকে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরে হাসপাতালে ১৫০ শয্যার জনবল দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ১৫০ শয্যার জনবল অপরিবর্তিত রেখে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে জেনারেল হাসপাতালে জনবল এবং চিকিৎসা উপকরণ সংকট দীর্ঘদিনের। গত প্রায় এক বছর ধরে চর্ম রোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্টের পদটি শূন্য। গত তিনমাস ধরে শূন্য চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্টের পদটিও। অথচ প্রতিদিন চর্ম রোগ বহির্বিভাগে দৈনিক প্রায় ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসত। অভিন্ন চিত্র চক্ষুরোগ বিভাগেও। চর্ম ও যৌন রোগ এবং চক্ষু বিভাগে কোনো চিকিৎসক না থাকায় বন্ধ হয়ে আছে রোগী দেখা।

তাছাড়া, গত ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর এক সঙ্গে হাসপাতালের ১১ জন সিনিয়র কনসালটেন্ট সহকারি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। এরপর থেকে চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। তদুপরি, চর্ম রোগ বিভাগের জন্য চিকিৎসক চেয়ে পরিচালক (স্বাস্থ্য) বরাবরে গত বছরের ২ মে, ৩ জুন, ২৭ জুন, ৩ আগস্ট এবং চলতি বছরের ২ জানুয়ারি পাঁচবার চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে নয়জন চিকিৎসকের পদ শূন্য আছে। জেনারেল হাসপাতালে ৪০ শয্যার মেডিসিন ওয়ার্ড, ১০ শয্যার কার্ডিওলজি, ৫০ শয্যার সার্জারি, ১২ শয্যার অর্থোপেডিক, ৫০ শয্যার শিশু, ২৪ শয্যার নাক কান গলা, ২ শয্যার চক্ষু, ১০ শয্যার কেবিন এবং ১৫ শয্যার পেয়িং বেড (টাকার বিনিময়ে) আছে। অন্যদিকে, এ হাসপাতালে মেগনেটিক রিজনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) মেশিন আছে একটি। তবে সেটি এখন নষ্ট।

তিনটি ইসিজির মেশিনের মধ্যে দুইটিই মেরামত অযোগ্য। সাতটি এ্যানেসথেসিয়া মেশিনের মধ্যে পাঁচটিই মেরামত অযোগ্য। একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেটি মেরামত অযোগ্য হওয়ায় নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে। তিনটি এক্সরে মেশিন আছে, তবে সেগুলোও মেরামত অযোগ্য। এভাবে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরকারি সেবাকেন্দ্রটি চলছে মেরামত অযোগ্য চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে। ফলে হাসপাতালে আগত রোগীরা আশানুরূপ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। ছোট ছোট রোগ নির্ণয়ের জন্যও রোগীদের চমেক হাসপাতাল বা বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় আর্থিক অস্বচ্চল, গরীব ও অসহায় রোগীদের চরমভাবে বিপাকে পড়তে হয়। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আরেকটি বড় সমস্যা- রোগীবান্ধব অবকাঠামো না হওয়া।
কারণ এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সড়কের পাশেই, নিচ তলায়। কিন্তু শিশু, মেডিসিন, গাইনির মত অত্যন্ত জরুরি বিভাগগুলো পাহাড়ের ওপর। এসব ওয়ার্ডে যানবাহন যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। ট্রলি কিংবা হুইল চেয়ারে রোগী বহনেরও ব্যবস্থা নেই। মারাত্মক মুমূর্ষু কোনো রোগীকে জরুরি বিভাগ থেকে অন্তবিভাগে নিতে হলে চরমভাবে বিপাকে পড়তে হয় রোগীর স্বজনদের। পড়তে হয় দুর্ভোগে। সেবা গ্রহণের বিভিন্ন ভবন, ওয়ার্ড এবং রোগ নির্ণয় বিভাগগুলো রোগী বান্ধব না হওয়ায় চট্টগ্রামের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালের রোগীরা আশানুরূপ সেবা পায় না, সংকট থাকে রোগীর। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ১৫০ থেকে ১৭০ এর চেয়ে বেশি রোগী থাকে না। কেবল রোগীবান্ধব অবকাঠামো না হওয়ায় সেবা বঞ্চিত হয় রোগীরা। একই সঙ্গে এ হাসপাতালের এক্সরে, ইসিজি ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি বিভাগও পাহাড়ের উপরে, তিনটি রোগ নির্ণয় কেন্দ্র তিন জায়গায়। ফলে রোগীরা সহজে তা খুঁজেও পায় না। তাছাড়া রক্ত পরীক্ষা বিভাগও পৃথক আরেক ভবনে, প্রশাসনিক ব্লকে।
চার. জেনারেল হাসপাতাল নিয়ে সাধারণ রোগীদের অভিযোগ অন্তহীন। সাধারণ রোগীদের নিয়মিতই অভিযোগ থাকে যে, এটি নামেই জেনারেল হাসপাতাল। রোগীরা পায় না প্রয়োজনীয় সেবা।

সাধারণ কোনো রোগ নিয়েও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলে চমেক হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। কোনো অপারেশন বা সার্জারির জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন আধুনিক মেশিন থাকলেও এসব দীর্ঘদিন ধরেই নষ্ট পড়ে থাকে। ভাল থাকলেও দায়িত্বশীলদের অবহেলার কারণে রোগীরা সেবা পায় না। তাছাড়া, একজন মুমূর্ষু রোগীকে জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার মত কোনো ব্যবস্থাই নেই। রোগীকেই পায়ে হেঁটে ওয়ার্ডে যেতে হয়। জরুরি বিভাগ থেকে হুইল চেয়ার দিয়ে রোগীকে নেওয়াটা প্রয়োজন হলেও তা সম্ভব হয় না।
বিশেষ করে গাইনি, অপারেশন থিয়েটার ও শিশু রোগীর ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। রোগীদের এমন অভিযোগের ফিরিস্ত অনেক দীর্ঘ। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে। সরকারি এ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটিকে কি সত্যিকার অর্থে একটি সেবাকেন্দ্রে পরিণত করা যায় না। সরকার সব ক্ষেত্রেই উন্নয়ন করছে। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু অতিজরুরি স্বাস্থ্য খাত কেন অবহেলিত থাকবে? কেন অবহেলিত-উপেক্ষিত জেনারেল হাসপাতাল? কেন এ হাসপাতাল থেকে আশানুরূপ সেবা পায় না সাধারণ রোগীরা। আর নয় অবহেলা, উপেক্ষা। সবার প্রত্যাশা, প্রকৃত অর্থেই সেবাকেন্দ্র হোক এটি। সেবা পাক সাধারণ অবহেলিত জনগোষ্ঠী। হাসি ফুটুক অসহায় দরিদ্রের মুখে।

রেজা মোজাম্মেল গণমাধ্যমকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট