চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.)

এসএম ফখরুল ইসলাম নোমানী

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

“চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়ায় হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.)এর প্রিয় জন্মস্থান। তার পিতার নাম শাহ মাওলানা আবদুল মোনাফ (রহ.)। তিনি ছিলেন পীরে কামেল হযরত মাওলানা সুফি ছদরুদ্দিন (রহ.)এর মুরিদান। পাকিস্থান শাসন আমলে এলাকায় সকলেই মাওলানা সাহেব নামে সম্বোধন করতেন। তার তিন সন্তান এবং তিন কন্যার মধ্যে হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.) ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। শৈশবকাল থেকে চালচালন, কথা-বার্তায়, আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও দ্বীনি শিক্ষার প্রতি প্রচ- আগ্রহ, ধীরে ধীরে আল্লাহর একত্ববাদ ও আনুগত্য প্রকাশ এবং নবীপ্রেমে ভালোবাসা তার চরিত্রে ফুটে ওঠে।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা দারুল উলুম হতে সফলতার সাথে কামিল ডিগ্রি পাশ করে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন বিভিন্ন সামাজিক এবং দীনি কাজে। তিলে তিলে গড়ে তোলেন এক বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। বোয়ালখালী উপজেলার প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন ও ওস্তাদুল ওলামা হযরত শাহ মাওলানা আবদুল হক (রহ.) এর কাছে একনিষ্ঠ ভাবে বিভিন্ন বিষয়ে কোরান হাদিসের আলোকে শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে তালিম নিতেন এবং এক সময় এই বুড়া মাওলানা নামে খ্যাত এর খুবই আপনজন হয়ে পড়েন। হযরত বুড়া মাওলানার ইন্তেকালের পর একমাত্র হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.)তাঁর শূন্যতা পূরণ করেন এবং পথহারা মানুষদের দীনের দাওয়াত, আল্লাহর একত্ববাদ এবং আশেকে রসুলের কাতারে সামিলের পরামর্শ দিয়ে যান।

হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.) নিজেকে স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ না রেখে বোয়ালখালীসহ চট্টগ্রামের বড় বড় আলেমেদ্বীন, পীর মোশায়েক ও বুজর্গণদের সাথে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশাসহ ওয়াজ মাহফীলেও গুরুত্বপূর্ণ তকরির করে দীনের খেতমত এবং রাসুলপাক (স.) জীবনলোচনা জনগণের মধ্যে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতেন। এক সময় তিনি বোয়ালখালীতে প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন এবং শিক্ষানুরাগীতে পরিণত হন। হযরতে গারাঙ্গীয়া এবং খলীফায়ে গারাঙ্গীয়া, চুনতীর শাহ সাহেব কেবলা, হযরত মাওলানা আতিকুলাøাহ শাহ (রহ.), হযরত শাহ আবদুল বারী (রহ.), ইমামে আহলে সুন্নাত, বায়তুল শরীফের পীর সাহেব কেবলা পটিয়ার শাহ মাওলানা মুছা মোজাদেদ্দী (রহ.)সহ চট্টগ্রামের বাঘা বাঘা আলেমেদীনদের সাথে ছিল তার একান্ত ঘনিষ্টতা। এক সময় তিনি গারঙ্গীয়ার বড় হুজুরের কাছে বায়াতও হন। বোয়ালখালীতে বেশীরভাগ বড় বড় নামাজে জানাজায় ইমামতিতে হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.) এর আগমন পরিলক্ষিত হতো, এলাকার মানুষ তার উপস্থিতি কামনা করতো। ইসলামিক ফরায়েজ সম্পর্কিত জটিল সমস্যার সিদ্ধান্তে এবং সমাধানে হযরত মাওলানার বিকল্প কেউ ছিল না বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে।
প্রিয় রাসুল (সা:) এর ভালোবাসাময় আকুলতায় তারা হয়েছেন সৃষ্টির দিশারী, পথহারাদের পাঞ্জেরী, তাদের নূরানী কর্ণকুহরে যেন প্রতিনিয়ত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় নিপীড়িতদের আহাজারি, বঞ্চিতদের রোনাজারি। একজন মানুষকে যে সুমহান উদ্দেশ্য নিয়ে খোদা তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টিরূপে দুনিয়াতে পাঠান মানুষ যখন তা ভুলে যায় তখন খোদার প্রতিনিধি হয়ে নবী (সা.) এর আদর্শকে বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে সলফে সালেহীনগণ সথ্যযুগের যাঁরা সংস্কারক থাকেন তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সে সমস্ত পথভোলা মানুষকে খোদার পথে এনে জান্নাতের সুঘ্রাণ দেয়ার। যার হৃদয়ে নবীর প্রেম থাকে, যারা আশেকে রসুল (সা.) এ পরিণত হয়, তার জীবনতো সুন্নাতের অলংকারে সুসজ্জিত থাকবে। তার চলাফেরায়, চিন্তাধারায়, কথা-বার্তায় ইসলামের জ্যোতি, সুন্নাতের প্রীতি, খোদার ভীতি হবে দৃশ্যমান, নফসের প্রভাব ¤্রয়িমান, ইনসানিয়াত হবে বেগমান। সর্বোপরি খুঁজে পাবে এহসান তথা খোদার সন্ধান, মারেফতের সুঘ্রাণ, জান্নাতের মেশক আম্বর সুঘ্রাণ। হযরত মাওলানা দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক সময় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সফলতার সাথে শিক্ষকতা করে তিনি ঘরে ঘরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে গেছেন এবং বেশকয়েকবার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের সম্মাননা পান উপজেলা পর্যায়ে। পাশাপাশি দীর্ঘ ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব এবং দীনি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করে এলাকাকে দ্বীনের আলোয় আলোকিত করে বহু ছাত্র এবং আলেম সমাজ রেখে যান।
নিজেকে বিভিন্ন দীনি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। যখনই সময় পেতেন আল্লাহর ইবাদত, রিয়াজ এবং আধ্যাত্বিকতায় নিজেকে মশগুল রাখতেন। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করেননি। সারাজীবন হক কথা বলেছেন। ইসলাম বিদ্বেষী এবং আল্লাহর একত্ববাদ এবং নবীর প্রেমে যারা বাধা সাজতেন তাদের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার এবং প্রতিবাদী ছিলেন। বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরার পীর সাহেব কেবলা হযরত শাহমাওলানা মীর রশীদ আহমেদ (রহ.)এর ২য় কন্যার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর একত্ববাদ, আনুগত্য এবং আশেকে রসুলের কাতারে নিজেকে শামিল করেছেন। সব দিক দিয়ে সৎ, ধার্মিক, আল্লাহওয়ালা একজন গ্রহণযোগ্য সম্মানি ব্যক্তি হিসেবে তার ছিল যথেষ্ট সুনাম।

তিনি আধ্যাতিœক জ্ঞান সাধন কর্মে প্রচুর মোশাহিদা করেন। তিনি মোরাকাবা মোশাহিদায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তাহাজ্জুদসহ ফজরের নামাজের পর সকাল ৮টা পর্যন্ত মোরাকাবা করতেন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত কোরান এবং হাদিসের চর্চা করতেন। তার আপন নিবাসে একটি বিশাল লাইব্রেরি ছিল। অত্যন্ত স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে সবার সাথে তিনি মিশে যেতেন। তার বুদ্ধিদীপ্ত আকর্ষণ ক্ষমতা, উষ্ণ ¯েœহ প্রবণতা, দায়িত্ববোধ, উন্নত জীবনাদর্শ, সেবামূলক মনোভাব, জ্ঞানপিপাসু মন, ভক্ত ও সাগরিকদের প্রতি মমত্ত্ব, নৈতিক আদর্শ, মানসিক সুস্থতা, ধৈর্য্য, দৃঢ়চেতা মনোভাব, সমাজ সচেতনতা, ব্যক্তিগত অধিকার ও মর্যাদায় বিশ্বাস, নির্ভীকতা, দল মত জাতি নির্বিশেষে সবার প্রতি সম্প্রীতি ও সদ্ভাব সারা জীবন অক্ষুন্ন ছিল। তাঁর খোদাভীরুতা, রসুল-প্রেম, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন বলয়ে নৈতিকতা ও আধ্যাতিœক সফলতা দেশ ও জাতির মুক্তির দিশা হিসেবে ভূমিকা পালন করতো। তাঁর উপস্থিতি যে কোন মজলিশ বা অনুষ্ঠানকে উদ্ভাসিত ও আলোচিত করতো।

হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দর শাহ (রহ.) ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪, ৫ পৌষ ১৪২১, ২৫ সফর ১৪৩৬ হিজরী রোজ শুক্রবার সকাল ৮ ঘটিকায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এই দুনিয়া হতে পর্দা করেন। ঐ দিনই আছরের নামাজের পর তার বড় ছেলে শাহজাদা মাওলানা মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম নোমানী এর ইমামতিতে এবং তৎকালীন সময়ে হাজার হাজার মানুষের সমাগমে হযরত মাওলানার নামাজে জানাজা এবং দাফন সম্পন্ন হয়। তার দাফনকর্ম পরিচালনা এবং আখেরী মোনাজাত করেন শাকপুরার পীর সাহেব কেবলা শাহ মাওলানা নুর মোহাম্মদ মুজাদেদ্দী (রহ.)। হযরত মাওলানার রুহের মাগফেরাত কামনায় এলাকার হাজার হাজার জনতা মোনাজাতে শরীক হোন। তার বাবা শাহ মাওলানা আবদুল মোনাফ (রহ.)ও মা বেগম ছাহেবার কবরের পাশে তাকে শায়িত করা হয়।
আসুন, বর্তমানের ফিতনার এই সময়ে আমরা সকলেই হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.)সহ হককানী এবং দ্বীনদার আলেমদের ছায়াতলে এসে নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজে নেই। মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ তিনি যেন আমাদের সকলকে হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সেকান্দার শাহ (রহ.) এর ফয়েজ দ্বারা ধন্য করেন। আমিন।

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী হেড অব ফাইন্যান্স, এপিক হেলথ কেয়ার লিঃ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট