চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আমেরিকা : উপনিবেশ থেকে স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র

ড. মাহফুজ পারভেজ

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সামরিক ও অর্থনীতির শীর্ষস্থানের অধিকারী, বর্তমান বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র একদা ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অধীনস্থ কলোনি বা উপনিবেশ। আমেরিকার নানা অঞ্চল ছিল ইউরোপের নানা দেশের দখলে। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে দেশটি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মতাদর্শ গ্রহণ করে বিশ্বসেরা হয়েছে। উপনিবেশ থেকে আমেরিকার স্বাধীন ও শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র রূপে গড়ে উঠার ইতিহাস অনেকেরই আগ্রহ ও মনোযোগের বিষয়।

আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সন্নিহিত অঞ্চলের দেশগুলো আবিষ্কৃত হয় ষোড়শ শতকে। জন ক্যাবট নামক একজন ইংরেজ প্রশাসক সর্বপ্রথম আমেরিকার পূর্ব উপকূলে পৌঁছান এবং মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া ইত্যাদি এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।
অবশ্য তারও আগে, ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্পেনের পতাকা বহন করে আমেরিকা মহাদেশের বর্তমানের পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কার করেন। কলম্বাসের দেখানো সমুদ্রপথ ধরে অপরাপর স্পেনিশ দখলদারগণ পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে অধীনস্থ করেন। কেবল ব্রাজিল বাদ পড়ে স্পেনিশ আগ্রাসন থেকে। ব্রাজিলে কায়েম হয় আরেক ঔপনিবেশিক দখলদার পর্তুগালের কর্তৃত্ব। জন ক্যাবট দ্বারা আমেরিকায় প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশটির পূর্ব-উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটেনের তৎকালীন রাজা সপ্তম হেনরি’র শাসন কায়েম হয়। যেহেতু ক্যাবট ছিলেন একজন ব্রিটিশ, তাই তিনি সপ্তম হেনরির হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দেন।

এরইমাঝে আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে এবং স্থানীয় আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নিধন ও নির্মূল করে উপনিবেশ তৈরি হতে থাকে। উপনিবেশ গঠনের কাজে আফ্রিকা থেকে শত শত জাহাজ ভর্তি করে কালো মানুষদের দাস হিসাবে নিয়ে আসা হয়। চলতে থাকে দাস ব্যবসা এবং অবাধে সম্পদ লুণ্ঠন। নিউল্যান্ড বা নিউ ওয়ার্ল্ড নামে পরিচিতি সদ্য-আবিষ্কৃত নতুন অঞ্চল আমেরিকা ভূখ-টি ইউরোপীয় নানা দেশের শোষণ, নির্যাতন ও আধিপত্য কায়েমের ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ইতিহাস জানাচ্ছে যে, ইংরেজরা বর্তমান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে দখল করলেও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের আজকের ফ্লোরিডা ও আশেপাশের এলাকায় শাসন প্রতিষ্ঠা করে স্পেন। ফরাসিরা নোভো-স্কটিয়া অঞ্চলে, ওলন্দাজ বা ডাচগণ হাডসন নদীর উপত্যকায় এবং সুইডিশরা ডেলাওয়ার অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ কায়েম করে।
ঐতিহাসিক তথ্য মতে, আমেরিকার প্রথম স্বীকৃত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০৭ সালে, জেমস টাউন-এ। ১৭৩২ সালে পুরো অঞ্চলে উপনিবেশের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩টিতে এবং সকল উপনিবেশই ছিল ইউরোপের বিভিন্ন শক্তির দখল কর্তৃত্বে।
১৬৬৪ সালে ব্রিটিশরা ওলন্দাজদের হটিয়ে দিয়ে ওলন্দাজ-অধিকৃত অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এরপর স্পেন-অধিকৃত অঞ্চলেও ইংরেজরা নিজেদের শাসন কায়েম করতে সক্ষম হয়। অবশেষে ১৭৬৩ সালে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইংরেজরা সমগ্র আমেরিকার উপর নিজেদের দখল ও শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

ব্রিটিশ অধিকৃত সমগ্র আমেরিকায় উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সেখানে তীব্র হয় স্বাধীনতার আন্দোলন, যা মাত্র ১৩ বছরের মাথায় ভেঙে পড়ে ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে। ১৭৭৬ সালে ১৩টি উপনিবেশ একত্রে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের মুক্তির দাবিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। উপনিবেশগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা ও ঐকের পাশাপাশি নিজস্ব সামরিক বাহিনীও গড়ে তুলে। ৪ জুলাই, ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করে ১৩টি উপনিবেশের নেতৃবৃন্দ।
৪ জুলাই (১৭৭৬) তারিখটি আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কারণ, এদিনে স্বাধীন-স্বাবভৌম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সূচনা হয়। বর্তমানেও ৪ জুলাই সেদেশের স্বাধীনতা দিবস রূপে পালিত হয়।
তবে ১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের কবল থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল অবয়বটি সম্পূর্ণ হয় দীর্ঘ শাসনতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৮৭ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকার সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৩টি রাজ্য নিয়ে এককেন্দ্রীক রাষ্ট্র থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। দেশটি প্রজাতান্ত্রিক নীতিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃত্ব শাসিত হওয়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করে।

দুই বছর পর ৪ মার্চ, ১৭৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সকলের সম্মতির ভিত্তিতে কার্যকর হয়। সংবিধান অনুযায়ী মার্কিন সংসদে দুটি কক্ষ থাকে। একটি নিম্নকক্ষ বা প্রতিনিধি সভা (হাউস অব রিপরেসেনটিটিভ) এবং অপরটি উচ্চকক্ষ বা সিনেট। একই বছর ৩০ এপ্রিল প্রথম মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসাবে জর্জ ওয়াশিংটন এবং উপ-রাষ্ট্রপতি হিসাবে জন অ্যাডামস নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন।
প্রাথমিকভাবে ১৩টি রাজ্য নিয়ে গঠিত হলেও বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ৫০টি। এর বাইরে ফেডারেশ শাসিত রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, পাঁচটি মেজর টেরিটোরি ও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র দ্বীপও রয়েছে বিশাল এ দেশের মধ্যে।
আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ১৭৭৬ সালে শুরু হয়ে ২৪৪ বছরের আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ইতিহাস ২৩৩ বছরের। বলা বাহুল্য, আজকের এই মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু শুরুতে এতো প্রবল ছিলনা। ছিল সাদা আর কালোর গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। যে কারণে প্রায় আড়াই শ বছরের পুরনো রাষ্ট্র হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তি হিসাবে অতি নবীন।

কারণ রাষ্ট্র গঠনের প্রথম ১৫০ বছর আভ্যন্তরীণ সমস্যার মোকাবেলা ও পুনর্গঠনের কাজে ব্যস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এই সময়কালে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণে দেশটির বিদেশ নীতি ইচ্ছুক ছিলনা। মার্কিনি পররাষ্ট্র নীতির ইতিহাসে এই সময়কালকে বলা হয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী পর্যায়’।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবলভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বিশেষত ১৯৪০ সাল থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে দেশটি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অগ্রসর হয়, যার ফলে মহাযুদ্ধ বিজয়ের অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
তারপর স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডা যুদ্ধকালীন উত্তপ্ত দ্বিমেরু কেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ব্লকের বিপরীতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্ব দেয়। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর এককেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব হলে বিশ্ব রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হয় যুক্তরাষ্ট্র। এবং কঠিন পথ পেরিয়ে উপনিবেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমে ক্রমে একবিংশ শতকের পৃথিবীতে একক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ কবি-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট