চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

প্রাণের ভাষায় মনের কথা

গণহত্যা ও জেনোসাইড

আঞ্জুমান রোজী

২৭ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৪০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা বাঙালি নিধনকে অনেকে শুধুই একটি গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। আসলে এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত জেনোসাইড। জেনোসাইড এবং গণহত্যা, এই দুই শব্দের মধ্যে তাত্ত্বিক অর্থে বিপুল পার্থক্য রয়েছে। গণহত্যা জেনোসাইডেরই একটি অংশ। একটি জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে ধ্বংস করার মানসিকতা নিয়ে যে হত্যাকা- ও ধংসযজ্ঞ পরিচালিত হয় তাকেই জেনোসাইড বলে বিশেষভাবে আখ্যায়িত করা হয়। একটি দেশে সংগঠিত কিংবা অন্য একটি দেশ এসে আক্রমণ করে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে হত্যাকা- চালালে তা হয় গণহত্যা। এটাকে মাসকিলিং বা গণহত্যা বলা যেতে পারে। এসব হত্যায় নির্মূল করার মানসিকতা নাও থাকতে পারে। শুধু দুর্ঘটনা বলে অনেকসময় তা চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু জেনোসাইড হচ্ছে সম্পূর্ণ একটি জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে নিঃশেষ করার মানসিকতা নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা, যা দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল। তাই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিরা যে গণহত্যা সংঘটিত করেছে তা জেনোসাইড হিসেবে অভিহিত করাই শ্রেয়। কারণ পাকশাসকেরা বাঙালি জাতিকে সমূলে বিনাস করে দিতে চেয়েছে।
জেনোসাইড শব্দের আবিস্কারক রাফায়েল লেমকিন। পনেরো বছর লেগেছিল জেনোসাইড শব্দটি আবিস্কার করতে এবং তর্কের খাতিরে এর তত্ত্ব, উপাত্ত আর যৌক্তিকতা তুলে ধরতে। জেনোসাইড শব্দটি ইস্টাবলিশড করতেও রাফায়েল লেমকিনকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে, হতে হয়েছে বিতাড়িত, প্রতারিত এবং অপমানিত। গ্রীক ‘এবহড়ং’ শব্দের অর্থ গোত্র, গোষ্ঠ্,ী গ্রুপ; আর ল্যাটিন শব্দ ‘পরফব’এর অর্থ কিলিং অর্থাৎ হত্যা। এই দুটি শব্দ এক করে রাফায়েল লেমকিন অনেকক্ষেত্রে মাসকিলিং বা গণহত্যার মধ্যে বিদ্যমান প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে নতুন ধারণার বশবর্তী হলেন এবং নতুন এক শব্দের জন্ম দিলেন ‘এঊঘঙঈওউঊ’ নামে। যা ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভায় ‘ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব চৎবাবহঃরড়হ ধহফ চঁহরংযসবহঃ ড়ভ ঃযব ঈৎরসব ড়ভ এবহড়পরফব’ নামে আধুনিক পৃথিবীতে মানবাধিকারের প্রথম চুক্তিনামা হিসেবে গৃহীত হয়। কোন জনগোষ্ঠীকে তার জাতিগত, গোত্রগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়; এই চারটি পরিচয়ের কোনো একটির জন্য যদি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করে ফেলার উদ্দেশ্যে কোনো হত্যা ও ধংসযজ্ঞ হয় তাহলে সেটাই জেনোসাইড।
বাংলাদেশে একাত্তরে পাকিস্তান যে হত্যা ও ধংসযজ্ঞ পরিচালিত করেছে তা হচ্ছে একটি ফুলফেইজ জেনোসাইড। বাঙালি জাতিগোষ্ঠিকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, জোরপূর্বক দেশান্তরি এবং ধর্মান্তরকরণ, সম্পদ ধ্বংস; এসব নির্মমতা বলে দেয় এটি একটি জেনোসাইড। অথচ বছরের পর বছর এটিকে শুধু একটি গণহত্যা বলা হচ্ছে। এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে ব্যাপক খোঁজ-খবর ও গবেষণার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট