চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আযান ধ্বনির আকর্ষণ মানুষকে শুধু দুনিয়া নয় আখিরাতও মধুময় করে তোলার স্মৃতি জাগায়

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

নামাজের সময় এলে একজন লোক উচ্চৈস্বরে আল্লাহ্র ইবাদতের সময় হয়েছে বলে মুসল্লিদেরকে আল্লাহ্ দরবারে হাযির হওয়ার জন্য আহবান জানায়। এই আহবান কে ‘আযান’ বলে। যে আযান দেয় তাকে বলা হয় মোয়ায্যিন। বিনা বেতনে কিংবা কোন বিনিময় আশা ব্যতিরেকে আযান দেয়ার ফযিলত অনেক বেশি। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে ঃ ওয়ামান আহসানু কাওলাম মিম্মান দাআ ইলাল্লাহ…তার কথার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে ব্যক্তি মানুষদের আল্লাহ্র পথে আহবান করে ও সৎকাজ আন্জাম দেয় আর বলে নিঃসন্দেহে আমি মুসলমানদের একজন। মহানবী (সা.) জামাআতে নামায পড়তে তাগিদ দিযেছেন।জামাআতে নামাজের জন্য কিভাবে ডাকতে হয় কেউ জানত না। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সাহাবীদের নিয়ে একদিন পরামর্শে বসলেন, আলোচনা চল্ল। কেউ বল্ল নামাজের সময় হলে ঘন্টা বাজানো হোক। কেউ বললেন শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে ডাকা হোক। অন্য একজন বললেন আগুন জ্বালানো হোক। আরও অনেকে অনেক কথা বললেন। নবী করিম (সা.) কোনটাই পছন্দ করলেন না।

নিঝুম রাত, সাহাবী আবদুল্লাহ্ বিন যায়েদ (রাদি.) গভীর ঘুমে মগ্ন। স্বপ্ন দেখেন একজন ফেরেস্তা তাকে আযানের বাক্যগুলি শুনাচ্ছেন। ভোরে তিনি ঐ বাক্যগুলি মহানবী (সা.)-কে শুনালেন। আশ্চর্যের কথা হযরত উমর (রাদি.)ও একই স্বপ্ন দেখেন। বাক্যগুলো মহানবী (সা.)-এর খুব পছন্দ হলো। তিনি বুঝলেন এটি আল্লাহ্ তায়ালারই নির্দেশ। তিনি হযরত বিলাল (রাদি.) কে আযান দিতে বললেন। হযরত বিলাল (রাদিঃ) এর কন্ঠে ধ্বনিত হল প্রথম আযান। হযরত বিলাল (রাদি.) হলেন ইসলমের প্রথম মোয়ায্যিন। পরবর্তীকালে উচ্চ স্বরে আযান দেওয়ার ক্ষেত্রে হযরত উমরের সাহসী ভূমিকা ছিল ইসলামে উল্লেখযোগ্য। আজকে যেমন সুমধুর আযানের আওয়াজ কোন কোন দুর্ভাগাকে বিরক্তির উদ্রেক করে সে যুগেও বড় করে আযান দেওয়া ছিল মুসলমানদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হযরত উমরই মোয়াযযিনদের অভয়দান করেছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবের কারণে তৎকালীন কাফির মুশরিকগণ ইসলামের এ আহ্বান ধ্বনি রুখতে পারেনি। এজন্য কবি নজরুল আজকের আত্মভোলা আলিম মোয়াযযিনদের প্রতি আক্ষেপ করে বলেছেন :
আমিরুল মু’মিনীন!

তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি, জানেনা মোয়াযযিন….।’
সত্যিই দৈনিক পাঞ্জেগানা নামাযের আযান মুসলিম সমাজে প্রতিদিন নতুন করে আল্লাহর তাওহীদের ডাককে মূর্ত করে তোলে। এক অভাবনীয় হ্যামলনীয় ভাষায় মুসলিম শিশু কিশোর নারী পুরুষদের উদ্বেলিত করে তোলে সালাতের আহ্বানে। এজন্য হয়তো কায়কোবাদ বলেছিলেন,
কে ওই শোনালো মোরে আযানের ধ্বনি,
মর্মে সুর বাজিল কি সুমধুর,
আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী
কি মধুর আযানের ধ্বনি….।’ এ পবিত্র আযান ধ্বনির আকর্ষণ মানুষকে শুধু দুনিয়াতে নয়, আখিরাতও মধুময় করে তোলার স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। নজরুল এজন্য আগ্রহ ভরে গেয়েছিলেন, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মোয়াযযিনের আযান শুনতে পাই…।’ সত্যিই তার আশা ও তামান্না পূর্ণ হয়েছে। তিনি কবর পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের প্রাঙ্গণে যেখানে প্রতিনিয়ত এ আশেকে রাসূল কবরে থেকে আযান ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। হয়তো এটি তার পরকালীন নাযাতের এ বিশাল উসিলাও বটে।
এক হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি আযান দেবে ও ইকামত বলবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে তার ছগিরা গুনাহসমূহ মাফ করে তাকে বেহেস্তে প্রবেশ করানো হবে। অন্য এক হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি সাতবছর কাল বিনা বেতনে আযান দেবে, সে বিনা হিসাবে বেহেস্তে যাবে। অপর একটি হাদীস হতে জানা যায়, হাশরের ময়দানে মোয়ায্যিনের র্মযাদা ও মর্তবা এত বেশি হবে যে, সে যত লোকের ভিড়ের মধ্যে হোক না কেন, সকলের মাথার উপরে তার মাথা লক্ষ্য করা যাবে। উল্লেখ্য,আযান দেয়া এবং তা ছহীহ-শুদ্ধ হওয়ার জন্য কতিপয় মাসলা-মাসায়িল রয়েছে। যেমন আমাদের মনে রাখতে হবে ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বে আযান দিলে সে আযান ছহীহ্ নয়, পুনরায় আযান দিতে হবে। তা ফজরের আযান হোক বা জুমার আযান হোক লোক জমা থাক বা না থাক।
ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের বিধান হলো, নবী করিম (সা.) হতে শ্রুত এবং বর্ণিত অবিকল আরবী শব্দ গুলি ছাড়া অন্য কোন প্রকার বা অন্য কোন ভাষায় আযান দিলে তা ছহীহ হবেনা-যদিও তাতে আযানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। মহিলাদেরও জন্য আযান নেই। পুরুষেরাই আজান দিবে। মহিলাদের আযান দেয়া নাজায়েয। কেননা মহিলাদের উচ্চশব্দ করা এবং পর পুরুষকে শব্দ শুনান নিষেধ। সুতারাং মহিলা আযান দিলে পুরুষকে পুনরায় আজান দিতে হবে। পুনরায় আযান না দিলে যেন বিনা আযানে নামায পড়া হলো। পাগল বা অবুঝ বালক আযান দিলে সে আযান শুদ্ধ হয়না, পুনরায় আযান দিতে হয়। আযান দেয়ার সুন্নাত তরীকা এই যে, মোয়ায্যিনের গোসলের দরকার হলে গোসল করা এবং অযু না থাকলে অযু করে নেয়া উচিৎ। তারপর মসজিদের বাইরে কিছু উঁচু জায়গায় ক্বেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাতের শাহাদাত আঙ্গুল দুই কানের ছিদ্রের মধ্যে রেখে যথাসম্ভব উচ্চ শব্দে খোশ এলহানের সাথে নির্দিষ্ট বাক্যমালা উচ্চারণ করবে। আযানের মধ্যে মোট ১৫ টি বাক্য এবং ফজরের আযানে মোট ১৭ টি বাক্য। গানের মত গেয়ে বা উঁচু নিচু আওয়াজে আযান দেয়া ঠিক নয়। যথাসম্ভব আওয়াজ উচ্চ করে টেনে লম্বা করে আযান দেয়া উচিৎ। কিন্তু যেখানে আলিফ বা খাড়া যবর নেই, সেখানে টানা শুদ্ধ হবেনা যেখানে আলিফ, খাড়া যবর বা মাদ্দ আছে সেখানে টানা প্রয়োজন। এ সম্বন্ধে বিজ্ঞ আলিম উলমা,মসজিদেও ইমাম মুয়াজ্জিনসহ অন্যান্য সম্মানিত শিক্ষক ওস্তাদের কাছে শিখে নেয়া উচিৎ। আওয়াজ এত উচ্চ করা বা লম্বা টানা ঠিক নয় যে, নিজের দম ফেলতে কষ্ট হয়।

জুমার ছানী আযান অপেক্ষাকৃত কম আওয়াজে হওয়া বাঞ্চনীয়। কারণ ঐ আযান দ্বারা শুধু উপস্থিত লোকদেরকে সর্তক করা হয়। যাতে খুৎবা শুনার জন্য মুসল্লিগণ দায়িত্বশীল মন নিয়ে অগ্রসর হয়। পুরুষ হোক মহিলা হোক পবিত্র অবস্থায় যে কেউ আযানের আওয়াজ শুনবে তার জন্য আযানের জওয়াব দেয়া মুস্তাহাব, কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। কিন্তু কেউ কেউ মুস্তাহাব উক্তিকেই প্রধান্য দিয়েছেন। কোন কোন আলিম বলেছেন যে, আযানের জবাব দুই প্রকার,(১)মৌখিক জবাব দেয়া এবং(২) ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদে জামাতে হাযির হওয়া ওয়াজিব। এখানে মৌখিক জবাবের কথাই বলা হচ্ছে। যদি কেউ আযানের জবাব ভুলবশত: কিংবা স্বেচ্ছায় সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে থাকে, তবে স্মরণ হলে কিংবা ইচ্ছা করলে আযান শেষ হয়ে যাওয়ার পর (অনেক সময় অতিক্রান্ত না হলে) জবাব দেয়া যায়।-(বেহেস্তি জিওর)। জুমার প্রথম আযান হওয়া মাত্রই সমস্ত কাজকর্ম পরিত্যাগ করে মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া ওয়াজিব। ঐ সময় বেচা-কেনা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া হারাম। (বিস্তারিত দেখুন সূরা জুমার তাফসীর)।
আমরা যেন কখনো আযান-আহবান উপেক্ষা না করি। আল্লাহ্র ইবাদত বন্দেগীর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের উচিৎ নির্মল নিষ্পাপ জীবন গড়ার পানে ধাবিত হওয়া।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট