চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিয়ন্ত্রণে চাই সুচিন্তিত পদক্ষেপ যক্ষ্মা এখনও প্রাণঘাতী

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘গ্লোবাল টিউবারকিউলোসিস রিপোর্ট ২০১৯’-এ যক্ষ্মার যে চিত্র উঠে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ শেষে বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক কোটিতে দাঁড়িয়েছে। অথচ এর আগের জরিপ অনুযাযী বিশ্বে প্রতি বছর ৯০ লাখ মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হতো। ২০২টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। যক্ষ্মা রোগের বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বার্ষিক ভিত্তিতে নিয়মিতভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যক্ষা রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ৫৭ হাজার। অর্থাৎ বৈশ্বিক যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর প্রায় চার শতাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি লাখে ২২১ জন এ রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মেডিকেল কর্মকর্তা নাজিস আরেফিন প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন দেশে ৯৭৮ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। প্রতিদিন ১৬ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার শিকার হচ্ছে। আর দৈনিক মারা যাচ্ছে ১২৯ জন। দেশে যক্ষ্মা রোগের এই চিত্র মোটেও স্বস্থির নয়। এ অবস্থায় যক্ষ্মা বিষয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তার অবকাশ রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে মারাত্মক ১০ প্রাণঘাতী রোগের একটি হচ্ছে যক্ষ্মা। অপুষ্টি, দারিদ্র্য ও ঘনবসতির সঙ্গে যক্ষ্মার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এক সময় বলা হতো ‘যার হয় যক্ষ্মা তার নেই রক্ষা’। কিন্তু এখন সে প্রবাদবাক্য আর সত্য নয়। বিশ^ব্যাপী যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে নানামাত্রিক পদক্ষেপের কারণে রোগটি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৎপরতাও উল্লেখ করার মতো। তবে জনসচেতনতার অভাব এবং ওষুধপ্রতিরোধী’ বা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স (এমডিআর)সহ নানা কারণে আশাব্যাঞ্জক সাফল্য আসছে না। ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর) নিয়ন্ত্রণ এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে বহু ওষুধপ্রতিরোধী’ বা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স (এমডিআর) এবং ‘লুক্কায়িত’ যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যক্ষ্মা ধরা পড়ার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে নিয়মিত ও চাহিদামতো ওষুধ সেবন না করা, রোগীর অসচেতনতা এবং যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেকে এমডিআর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। যক্ষ্মায় আক্রান্তদের সেবা দেয়ার সময় সচেতন না থাকা, মুখোশ ব্যবহার না করা এবং হাসপাতালের পরিবেশ নোংরা ও জীবাণুযুক্ত থাকায় সেবিকা-সেবক, কর্মচারী এবং রোগীর স্বজনদের মধ্যে লুক্কায়িত যক্ষ্মার প্রকোপ দেখা দিচ্ছে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আবার এটি শনাক্ত করার জন্য দেশে যে পরিমাণ জিন এক্সপার্ট মেশিন থাকার কথা, তাও নেই। রোগীর সংখ্যানুপাতে যক্ষ্মা শনাক্ত করার আধুনিক জিনএক্সপার্ট যন্ত্র দরকার ১ হাজার ২০০টি। এখন সারা দেশে চালু আছে মাত্র ২২১টি। এ বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা ৪০০ হবে। যে বাজেট বরাদ্দ আছে, তাতে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে এ যন্ত্রের সংখ্যা দাঁড়াবে ৭০০টিতে। তারপরও ৫০০ যন্ত্রের ঘাটতি থাকবে। তাছাড়া এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় যেসব রোগী প্রাইভেট চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেন, তাদের অনেকের পক্ষে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া সম্ভব হয় না। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের বিভিন্ন শ্রেণির স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যেও লুক্কায়িত যক্ষ্মার প্রকোপ বাড়ছে। রোগটির সংক্রমণের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে একটি রূপ হলো লুক্কায়িত যক্ষ্মা। এমডিআর এবং লুক্কায়িত যক্ষ্মায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা কত, এ বিষয়ে সরকারি সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ভৌগোলিক হিসাবে গত এক বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মা রোগীর সন্ধ্যান পাওয়া গেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। বৈশ্বিক যক্ষ্মা রোগীর ৪৪ শতাংশই এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এ ছাড়া আফ্রিকায়ও এ রোগীর সংখ্যা ২৪ শতাংশ ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৮ শতাংশ এবং আমেরিকা ও ইউরোপে রয়েছে তিন শতাংশ করে। উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-২০১৫ খ্রিস্টাব্দে যক্ষ্মাকে মহামারি হিসেবে উল্লেখ করে এ রোগ নির্মূলের লক্ষ্যে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য কর্মকৌশল অনুমোদন করেছে। উচ্চাভিলাষী সেই কর্মকৌশল অনুযায়ী, ২০৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিশ্ব থেকে যক্ষ্মা রোগের মৃত্যুহার ৯৫ শতাংশ কমাতে হবে। পাশাপাশি শনাক্ত করা যক্ষা রোগীর হার ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে।
একটা সময় ছিল যখন কোনো বাড়িতে কারও যক্ষ্মা হয়েছে জানলে ওই বাড়ির আশপাশে কেউ যেত না। সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। তবে এখনো মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি আছে। এটিই যক্ষ্মা নির্মূলে প্রধান বাধা। আবার পরিবেশ দূষণ, দ্রুত নগরায়ন, ঘনবসতি, শিল্পাঞ্চল, দারিদ্র, বিপুল মানুষের চাপ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও চিকিৎসাসামগ্রীর অভাব, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমতো ওষুধ দেশে তৈরি করার সমস্যাসহ অন্য অনেক কারণেই যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব বিষয় আমলে নিয়ে যক্ষ্মা প্রতিরোধে তৎপর হতে হবে। যক্ষ্মাসম্পর্কিত মানসম্পন্ন তথ্য-উপাত্তও খুবই জরুরি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট