চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ঈদ বাজার : ফ্যাশন, রুচি ও আভিজাত্যের ছবি

চলমান জীবন

আবসার হাবীব

২২ মে, ২০১৯ | ১:২০ পূর্বাহ্ণ

ঈদের বাজার …….
ঈদের বাজার আস্তে আস্তে জমে উঠছে। পাশাপাশি এবার রোজা শুরুর আগে থেকেই ক্রেতাকে আকর্ষণ করার জন্য বাজারে-মার্কেটে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা লক্ষ্য করার মতো। আকর্ষণীয় সব পুরস্কার। পুরস্কারের আশায় কি মানুষ ঈদের বাজার করে – এমন বিশ্বাস অনেকেই করে না। তবে, ক্রেতারা কোনোকিছু কিনে না ঠকলেই নিজেদেরকে পুরস্কৃত মনে করবেন। কেউ বছরে একবার এই ঈদের সময় কাপড় কিনে সারা বছরের প্রয়োজন মিটায়। কেউ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী কেনে। কেউ বা কিছু কাপড় যাকাত হিসেবে দেয়। উচ্চবিত্তের কথা নাই বা বললাম, চট্টগ্রামের অনেকে ঈদের বাজার করার জন্য ঢাকা-কলকাতা পর্যন্ত ছুটছে। কেউ ঈদের সময় প্রিয়জনকে স্বর্ণের অলংকার সামগ্রী পর্যন্ত দিচ্ছে।
সবকিছু মিলে মানুষের মনে রোজার পর ঈদ উৎসব মানুষের মনে আনন্দ ছড়ায়, এখানে পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব মিলায় না। দুঃখকে ভুলে আনন্দের মধ্যে থাকতে চায় এই একটা দিন। তারপরেও, মানুষ হয়তো প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ ভুলতে পারে না। ঈদ সবার মনে আনন্দ ছড়িয়ে দিক সেই প্রত্যাশায় সাধারণত আমরা করি।
ঈদের বাজার এবং বিশ্বাসযোগ্যতা ………
ঈদের বাজারে পুরস্কার ঘোষণা দেখে ক্রেতা সাধারণ অবাক। তাই, রসিক জনের মন্তব্য : বিক্রিত পণ্য-সামগ্রীর সাথে এই পুরস্কারের টাকা নিশ্চিয় যোগ করে দেবে।
তা, হয়তো সত্য নয়। পুরস্কারের চেয়ে আমরা মনে করি ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য সবচেয়ে বেশী বড় প্রয়োজন একটি দোকান বা মার্কেটের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং পণ্যের মূল্য নির্ধারণ। এক দোকান থেকে একটি জিনিষ কিনলাম, কিন্তু অন্য দোকানে দেখলাম মূল্যের ব্যবধানটা অনেক বেশী। অনেক সময় নিজেও লজ্জায় পড়ে যায়। বাড়িতে ফিরে কম দামটায় বলেন নিজের সম্মানটা রক্ষার জন্য।
মাঝে মধ্যে বিভিন্ন আড্ডায়, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কিংবা পারিবারিক আড্ডায় বিভিন্ন দোকান বা মার্কেট সম্পর্কে মন্তব্য শুনি, যা অনেকটা এ রকম : ঐ মার্কেটে মূল্য বেশী, অমুখ মার্কেটের সেলস ম্যানদের ব্যবহার খারাপ, ঐ দোকানটা গলাকাটা দাম রাখে – ভাই তওবা করেছি ঐ দোকানে আর যাবো না। মূল্যের হের-ফের বেশী না থাকাই ভালো। ফিক্সড রেইট দোকানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠেছে। মাত্র কয়েকদিন আগে আমার পরিচিত এক ফিক্সড রেইট দোকানের মালিকের সাথে আলাপ হলে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি নিজেও কিছু কিছু দ্রব্য-সামগ্রী এদেশে আসে না বলে অতিরিক্ত দাম রেখেছিলেন একসময়। এখন আর তা করেন না। ফলে, তার দোকানে বিক্রি এখন আবার ধীরে ধীরে সেই কমে যাওয়ার দুর্দিন কাটিয়ে উঠছে।
এইরকম উদাহরণও এই শহরে আছে, বড় দোকান থেকে ২০০০ টাকা দামের শার্ট কিংবা প্যাণ্ট কিনে বাড়ি ফিরে দেখলো, নিজের ছেলেই পরের দিন একই প্যাণ্ট বা শার্ট ১৬০০ টাকা দিয়ে কিনে এনে সত্যি সত্যিই দেখালো। এভাবেই এক একটি দোকান বা মার্কেট তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। এইজন্যই আমরা বলি, সুনাম এবং দ্রব্যমান ঠিক থাকলে এবং সাথে যদি মূল্যটা যথাযথ হয়, তাহলে এক একটি মার্কেট বা দোকান সুনাম ধরে রাখা খুব একটা কঠিন না। তার সাথে ভালো ব্যবহার একটি দোকান কিংবা মার্কেটের সুনাম অনেক বাড়িয়ে দেয়। ক্রেতারা থাকে সন্তুষ্ট।
হকার মার্কেট …….
বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রই ছুটে যান হকার মার্কেটের দিকে। মানে জহুর হকার মার্কেটে। গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে এক সময়ের পুরোনো কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ‘টাল মার্কেট’, এখন ধনী-দরিদ্র সকলের প্রিয়। অনেকের মতে এই মার্কেট এখন উচ্চবিত্তের দখলে চলে গেছে। তারপরও, মহিলাদের চেয়ে পুরুষ তথা ছেলেদের সার্ট-প্যান্টের জন্য একটু দেখে-শুনে কেনাকাটা করলে ভালো কাপড় পাওয়া যায়। কিন্তু মোটামুটি দামে অন্যকে খুশী করার মতো কাপড় পাবেন। এই হিসেবটা উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের জন্যে।
একজন মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত নিজের ছেলে-মেয়েকে খুশী করার মতো কাপড়-চোপড় এখান থেকে পাবেন, কিন্তু একটু বেশি দাম এই ঈদের সময়ে। কারণ উচ্চবিত্তের জন্য এই দাম একটু কম হলেও আপনার জন্য বেশি। সবচেয়ে বড়কথা, আপনাকে এখানে ঈদ উৎসবের পোষাক কেনার জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। উচ্চবিত্ত কিনছে ড্রাইভার, চাকর, দরিদ্র নিকট আত্মীয়কে উপহার দেয়ার জন্য। কখনো কখনো পছন্দসই পেয়ে গেলে নিজের জন্যও। আর, আপনি কিনছেন নিজেদের প্রয়োজনে।
ফ্যাশন প্রতিবছর …….
ফ্যাশন শব্দের অর্থ ‘কেতা’ বা ‘কায়দা’। ‘কেতাদুরস্ত’ সেই জগত থেকে এমন ফ্যাশনেবল বা ফ্যাশন সচেতন নাগরিক। ফ্যাশন, চলতি কায়দা বা ঢং-এ আড়ালে নতুনমাত্রার সংযোজন। প্রতিবছরই কোনো না কোনো সিনেমার নায়ক-নায়িকাকে ঘিরে ফ্যাশনের আর্বিভাব ঘটে কখনো কারিনা, কখনো প্রিয়াংকা, দীপিকা, আলেয়া ভাট, জ্যাকলিন, পুরুষদের বা তরুণদের বেলায় কখনো শাহরুখ, কখনো আমির খান, রনধীর কাপুর, ঋত্বিক, টাইগারের পোষাক – ঈদ পোষাক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আবার বাংলাদেশের কোনো কোনো ফ্যাশন হাউসের কাপড় জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
পাঞ্জাবীর জন্য বিশেষ বিশেষ দোকানও জনপ্রিয় – আড়ং, দেশী দশ, আর বিশেষ করে চট্টগ্রাম কোতায়ালীর মোড়ের খাদিঘর মতো দোকানসমূহ। সার্ট-প্যান্ট-শাড়ী-জুতার জন্য বিভিন্ন ব্রান্ডের দোকানগুলো এখন খুবই জনপ্রিয়। এর পেছনে একটি কারণ সুনির্দিষ্ট মূল্য তালিকা। দরাদরি করতে হয় না। পছন্দ হলেই ছট-জলদি কেনা যায়। সময় বাাঁচে।
ফ্যাশন, নিজেকে ঠকাবেন না …….
ফ্যাশন হাউজ এবং বাজার-মার্কেটের দোকানগুলো মানুষের রুচি ও চাহিদার দিকে তাকিয়ে প্রতিবছর নতুন ফ্যাশন নিয়ে ঈদের বাজারে কাপড় ছাড়ে। ফ্যাশন হাউসগুলো জানে, যুগের সাথে পাল্টেছে ফ্যাশন বা রুচিবোধ দৃষ্টিভঙ্গী। আজ যেটা ফ্যাশন, কাল সেটা অচল। চলতি ফ্যাশনের পেছন পেছন ছোটে সব সময় জনরুচি। চাই নতুন ডিজাইন। প্রত্যেকেই সে ব্যাপারে এখন সচেতন। ক্রেতা ও বিক্রেতা সবাই এর সুযোগ নিচ্ছেন। সুন্দর নানা ডিজাইনের সব দেশী-বিদেশী কাপড়ে দোকানগুলো সেজেছে দৃষ্টিনন্দনভাবে। একমাত্র লক্ষ্য ক্রেতা সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ক্রেতাও তারপর পছন্দের কাপড়ের জন্য এ-দোকান সে-দোকান ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত। তবুও চাই পছন্দের কাপড়। এখানে পরিবারের সকলকে খুশী করার ব্যাপারটাও সামনে এসে দাঁড়ায়। কাপড় কেনার সময় ক্রেতা সাধারণ সেই দিকটাও বিবেচনা করে থাকে। নিজের আনন্দটা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে পরিবারের কর্তা ব্যক্তির আনন্দ।
সভ্যতার ক্রমবিকাশে ফ্যাশন পরিবর্তনশীল। পোষাক এখন আর শুধু লজ্জা নিবারণের জন্য নয়। পোষাক শুধু মানুষের প্রয়োজনই মিটায় না, শিল্পরুচি ও রূপময়তা মিলিয়ে ব্যক্তিত্বের আত্মবিকাশের এক উজ্জ্বল ছবি ফুটিয়ে তোলে। মানুষের রুচি ও আভিজাত্যের ছবিও খুঁজে পাই এই পোষাকেই। রঙের বাহার, কাপড়ের প্রকৃতি, বুননের মাধুর্যে বদলে যায় পোষাকের বৈশিষ্ট্য। ফ্যাশন কখনো ঐতিহ্যকে খুঁজে ফেরে, কখনো এগিয়ে যায়, কখনো একটু পিছিয়ে – তবে ফ্যাশন সবসময় নতুনের খোঁজে অগ্রসরমান। এই অগ্রসমানতা নিয়েই সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যায়।
পুনশ্চ : পুরনোর মধ্যে নতুন আনন্দ …………….
পুরনোকে নতুন করে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। তাই আমরা সবসময় ঐতিহ্যের পেছনে ছুটি। বাংলাদেশের ফ্যাশন সবসময় ঐতিহ্যমুখী।
তাই, ঘুরে ফিরে নতুন পুরানো মিলে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে আমাদের ফ্যাশন। বাংলার নদী ও মাটি, সবুজ ফসল, ছাই রঙের আকাশ, ফুলের বর্ণ বৈচিত্র্য বর্ষা ও শরতের প্রকৃতি মনোভূমিকে প্রভাবিত করে নিজস্ব একটি ধারা তৈরী হয়ে আছে। সেই ধারা বা ঐতিহ্যের হাত ধরে ডিজাইনাররা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিত্যনতুন ফ্যাশনে অবদান রাখছেন। সাথে সাথে ব্যক্তিত্ব বিকাশে ফ্যাশন সচেতনতা বাড়ছে। বাড়ছে মানুষের চাহিদা এবং সর্বশেষ বৈচিত্র্যময় পোষাকের জন্য ছুটছে। একজনের কাছে যা প্রিয়, অন্যজনের কাছে তা প্রিয় না-ও হতে পারে। তবে, নিজের পছন্দের পোষাকটি কিনুন, ভালো লাগবে।
তারপরও, সাবধান, যুগের বা নামের হাওয়ায় তাল মিলাতে গিয়ে ক্রেতা সাধারণ নিজেকে ঠকাবেন না। ঠকাবেন না ছেলে-মেয়েদেরকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট