চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর গড় আয়ু বৃদ্ধি একটি অনুসন্ধান

অধ্যাপক ড. নারায়ণ বৈদ্য

২১ মে, ২০১৯ | ১:২৯ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনীতির পাঠ্যক্রমকে পরিবর্তন করা হয়েছে। একসময়ে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজে অর্থনীতির বিষয়টির মধ্যে শুধুমাত্র একটি শাখা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেটি ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ (পলিটিকেল ইকোনমি)। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থার যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন নির্বাহের ধরণ এবং নতুন নতুন পণ্য আবিষ্কারের কারণে মানুষের আশা আকাক্সক্ষা ইত্যাদির পরিবর্তন হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সম্পদ আহরণের প্রচেষ্টায় মানুষ লিপ্ত রয়েছে। ফলে অর্থনীতির শাখা-প্রশাখারও পরিবর্তন হয়েছে।
কালক্রমে অর্থনীতিতে ভোক্তার এরূপ আচরণকে বিশ্লেষণ করার জন্য নতুন নতুন যে সব বিষয় সংযোজন করা হয়েছে তা হলো ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভোক্তার আচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্য এবং সরকারি আয় বৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিতে নতুন শাখার জন্ম হয় ‘সরকারি অর্থব্যবস্থা’ – নামক একটি বিষয়। এভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয়েছে এমন একটি বিষয় যেটাকে ‘উন্নয়ন অর্থনীতি’ বলা হয়। অনুরূপভাবে একটি দেশের জনসংখ্যা সেই দেশের সামগ্রিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। ফলে, অর্থনীতিতে নতুন আর একটি শাখা বিষয়ের জন্ম হয়েছে তা হলো ‘জনসংখ্যা অর্থনীতি’।
একটি দেশের জনসংখ্যা উক্ত দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করে বেশি। এই কারণে জনসংখ্যা অর্থনীতিতে জনসংখ্যার মাথাপিছু আয়, বয়স কাঠামো, জনসংখ্যা স্থানান্তর, জনসংখ্যা অভিক্ষেপণ, জনসংখ্যার গড় আয়ু ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়। অর্থনীতিতে জনসংখ্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে থমাস রবার্ট ম্যালথাস এক সময়ে ইংল্যান্ডে সাড়া জাগিয়েছেন। ম্যালথাস প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, ইংল্যান্ডে খাদ্য উৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যা বাড়ছে বেশি। কারণ, যে কোন দেশে জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে, আর খাদ্য উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১, ২, ৪, ৮, ১৬ এভাবে। আর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ১, ২, ৩, ৪, ৫ এভাবে। অর্থাৎ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলে, ইংল্যান্ডে খাদ্য ঘাটতি অবশ্যম্ভাবী। সেদিনের ম্যালথাসের তত্ত্বটি প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে ইংল্যান্ডবাসীর পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে যায়। ঘৌড়দৌড়ের মাঠে উল্লসিত জনতার হাসি সেইদিন থেমে গিয়েছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডে খাদ্যাভাব দেখা দেয় নি। এর উত্তরে ম্যালথাস বলেছিল, ইংল্যান্ডে খাদ্য উৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি বাড়ছে ঠিকই, তবে খাদ্যাভাব দেখা না দিলেও রুটি আগের তুলনায় পাতলা হয়ে গেছে।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সম্পর্কে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন তবে এই কথা সত্য যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। বৃদ্ধি প্রাপ্ত জনসংখ্যা যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশকে নষ্ট করে তেমনি মানুষের গড় আয়ুকেও হ্রাস করে। অবশ্য মানুষের গড় আয়ু অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া, মানুষের খাদ্যাভাস, চিকিৎসা সুবিধা, উন্নত চিকিৎসা ইত্যাদির ওপরও গড় আয়ু নির্ভরশীল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, একই পরিবেশে এবং একই খাদ্য অভ্যাস সত্বেও পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে গড় আয়ুর পার্থক্য দেখা যায়। বিশে^ ২০০০ সালের পর বিগত বছরগুলোতে মানুষের গড় আয়ু সাড়ে পাঁচ বছর বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে মানুষের পূর্ণ স্বাস্থ্যের আয়ুষ্কাল ৪.৮ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৩.৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। আর মানুষের এই আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে মানুষের উপার্জন। ফলে, উন্নত ও অনুন্নত দেশে মানুষের গড় আয়ুর ব্যবধান ১৮.১ বছর। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিশ^ স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান ২০১৯’- এর তথ্যে দেখা যায়, পুরুষের চেয়ে নারীর গড় আয়ুর পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ বিশে^র সর্বত্রই পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশিদিন বাঁচে। বিশেষ করে ধনী দেশগুলোতে এ কথা অধিক প্রযোজ্য। অন্যদিকে, ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে জানা যায়, বিগত ১৬ বছরে বিশে^ মানুষের গড় আয়ু সাড়ে পাঁচ বছর বাড়লেও একই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে সোয়া সাত বছর। কিন্তু কেন? বিশে^ অনেক উন্নত ও অধিক উন্নত দেশ রয়েছে। এইসব দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান, প্রোটিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ, উন্নত চিকিৎসা, ইত্যাদি বাংলাদেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। তারপরও কেন এবং কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বিশে^র উন্নত দেশের মানুষের গড় আয়ুর তুলনায় এক বছর নয় মাস বেশি বেড়েছে! অর্থনীতি বিষয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে এ প্রশ্নের উত্তর সোজাসাপটা দেয়া যায়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু, বিশে^র উন্নত দেশের জনগণের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গড় আয়ুর তুলনায় বেড়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিনামূল্যে বই প্রদান, ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান, ১৮ বছরের নীচে ছেলে-মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন, মাতৃমৃত্যু হ্রাসকল্পে বিভিন্ন ক্লিনিক স্থাপন (যেমন- সবুজ ছাতা, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি), গ্রামে গ্রামে পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োগ, মাতৃস্বাস্থ্য উন্নতিকল্পে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, সুন্দর-সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য শৌচাগার নির্মাণ ইত্যাদি পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ুকে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
গড় আয়ুর ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেসব দেশের নারীরা স্বাস্থ্যসেবা কম পায়, সে সব দেশে নারী-পুরুষের গড় আয়ুর ব্যবধান খুব কম। স্বল্প আয়ুর দেশে যেখানে স্বাস্থ্যসেবা দুষ্প্রাপ্য, সেখানে প্রতি ৪১ জন নারীর মধ্যে একজন মাতৃত্বজনিত কারণে মারা যায়। আর উন্নত দেশে প্রতি তিন হাজার ৩০০ নারীর মধ্যে একজন নারী মাতৃত্বজনিত কারণে মারা যায়। স্বল্প আয়ের ৯০ শতাংশ দেশেই প্রতি এক হাজার প্রসূতির মধ্যে মাত্র চারজন নার্সিং ও ধাত্রীবিদ্যার সুবিধা পায়। নারী পুরুষের গড় আয়ুর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের দৃষ্টিভঙ্গিও বড় ভূমিকা রাখে। যদি নির্দিষ্ট একটি এলাকায় একই পরিবারে নারী ও পুরুষ একই রোগে আক্রান্ত হয় তবে দেখা যায়, নারীর তুলনায় পুরুষ কম স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে যে, এইচআইভি আক্রান্ত দেশগুলোতে পুরুষের তুলনায় নারীরা অধিক সংখ্যায় এইচআইভি পরীক্ষা গ্রহণ করে। যক্ষ্মা রোগের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, নারীর তুলনায় পুরুষ স্বাস্থ্যসেবায় বেশি অনীহা প্রদর্শন করে। এ কারণে পুরুষের আয়ুষ্কালের তুলনায় নারীর আয়ুষ্কাল পৃথিবীর যে কোন দেশে বেশি।
বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে বৈশি^ক গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। কান্ট্রিইকোনমিক ডটকমের মতে, ২০০০ সালে বাংলাদেশে গড় আয়ু ছিল ৬৫.৩২ বছর। এর মধ্যে নারীর গড় আয়ু ছিল ৬৫.৬৮ এবং পুরুষের গড় আয়ু ছিল ৬৪.২৯ বছর। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে বাংলাদেশের গড় আয়ু যেমন বেড়েছে তেমনি উন্নতির হিসেবে নারীর গড় আয়ুও পুরুষের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭২.৪৯ বছরে। এর মধ্যে নারীর গড় আয়ু ছিল ৭৪.২৯ এবং পুরুষের গড় আয়ু ৭০.৮৯ বছর। অর্থাৎ এই সময়ে পুরুষের থেকে নারীর গড় আয়ু বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন বছর।
আবার আত্মহত্যার ঘটনা নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে বেশি ঘটে ৭৫ শতাংশ। ১৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় নারীর তুলনায় পুরুষ মারা যায় দুইগুণ বেশি। আর ঝগড়া-ঝাটিতে নারীর তুলনায় পুরুষ মারা যায় চারগুণ বেশি। এইসব কারণে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর গড় আয়ু বেশি।

লেখক : ফ্যাকাল্টি অব বিজ্নেস এড্মিনিষ্ট্রেশন বিজিসি ট্রাষ্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট