চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রমজানের তাৎপর্য ও আমাদের করণীয়

লায়ন এ. কে জাহেদ চৌধুরী

২১ মে, ২০১৯ | ১:২৮ পূর্বাহ্ণ

মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র মাস মাহে রমজানুল মোবারক। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের এই মাসের জন্য সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সারা বছর ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। এই পবিত্র ও বরকতময় মাস মুসলমান তথা বিশ্বাবাসীর জন্য সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ উপহার। কেননা এই মাসে কোন পুণ্য কাজ করলে সত্তর গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। মুসলমানদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল এই মাসে। এই কারণে মাহে রমজানের গুরুত্ব আরো অত্যধিক বেড়ে গেছে। পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ আল-কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে এই নশ্বর পৃথিবীতে মানুষ কোন না কোনভাবে পাপ করে থাকে। কিন্তু এই পবিত্র মাসে আল্লাহ তায়ালা বান্দার সমস্ত পাপ মোচন করে দেন। তাই মানুষ এই মাসে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে। বিশেষ করে রোজা পালন ছাড়াও মানুষ কোরআন তেলোয়াত, নফল নামাজ, জিকির আজগারসহ সাধ্যমত ইবাদত বন্দেগীতে মনোনিবেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে।
হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আসমানী কিতাবধারী অন্যান্য নবীদের উপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। তবে সেই রোজা পালনের নিয়মে ভিন্নতা ছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, “ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাই কুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন।” অর্থাৎ হে ইমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা খোদাভীরু হও।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে কারিমার দ্বারা বুঝা যায়, আমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সিয়াম একটি আরবী শব্দ। সিয়াম এর আভিধানিক অর্থ হল বিরত থাকা। অর্থাৎ সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও জৈবিক কর্মকা- থেকে নিজেকে বিরত রাখার নামই সিয়াম বা রোজা পালন। আল্লাহ পাক এই মাসে বেশি বেশি দান খয়রাত করার জন্যও বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। ঝগড়া-বিবাদ বা অন্য কারও সাথে কলহ পরিহার করতেও একজন রোজাদারের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। শুধুমাত্র উপবাস করার নাম রোজা নয়। সকল মোমিন বান্দা যেন আল্লাহ পাক নির্দেশিত এবং প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (দ:) কর্তৃক প্রদর্শিত পথে সিয়াম পালন করতে পারে, সেই প্রার্থনাই করি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, মানুষকে “আশরাফুল মাকলুকাত” বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কেননা আলাহ পাক মানুষকে ভাল ও মন্দ এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বুঝার জ্ঞান দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু মানুষ হয়েও যারা অন্যায়, ব্যভিচারসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে তাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সাবধান করেছেন। পশুর মধ্যে ভাল মন্দ পরখ করার মত জ্ঞান দেওয়া হয় নাই বলেই আল্লাহর সৃষ্টি জগতে তারা পশু। কিন্তু মানুষ হয়েও যারা নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে বা পশুত্ব বরণ করে, এই রমাজান মাস তাদের জন্য ক্ষমা বা আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের সুবর্ণ সুযোগ। এই রমজান মাসেও যারা ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে ক্ষমা লাভে ব্যর্থ হবে শেষ বিচারের দিন তাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে এই রমজান বা সিয়ামের মাসের উছিলায় ক্ষমা করেন।
আত্মশুদ্ধি বা সংযম প্রদর্শনের অপর নাম সিয়াম। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ব্যবসায়ীদের মধ্যে পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য কমানোর বা রোজাদারদের সম্ভাব্য স্বল্প মূল্যে ভোগ্য পণ্য সরবরাহের প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীগণ রমজান মাস এলেই পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের মূল্য তালিকা দেখলে ক্রেতাদের চোখ মাথায় উঠার অবস্থা হয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের অনুরোধসহ নানামুখী পদক্ষেপের পরেও এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী লাগামহীনভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়, যা পবিত্র সিয়াম পালনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এক্ষেত্রে সরকারের উচিৎ ভ্রাম্যমান আদালতের পরিধি বৃদ্ধি করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পবিত্র রমজান মাসে সামর্থ্যবান লোকেরা গরীব ও দুঃস্থদের মধ্যে যাকাত ফিৎরা বণ্টন করেন। যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সামর্থ্যহীন কোন লোককে স্বাবলম্বী করাই যাকাত প্রথার মূল উদ্দেশ্য। যাকাত গোপনে প্রদানই শ্রেয়। কিন্ত আমাদের দেশে এক শ্রেণীর ধনী ব্যক্তি লোক দেখানো যাকাত প্রদান করে থাকে। অনেকে মাইকিং করে বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যাকাত প্রদান করে। যার ফলে যাকাতের মূল উদ্দেশ্য তো পূরণ হয়ই না, উপরন্তু ইতিপূর্বে বহুবার যাকাত আনতে গিয়ে নারী-পুরুষসহ অনেক লোক নিহত হয়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধরনের কর্মকা- কোনভাবেই ইসলামের যাকাত প্রদান নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এব্যাপারে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন থাকা উচিৎ বলে ভুক্তভোগী ও সচেতন মহল মনে করেন।
ইংরেজীতে একটি কথা প্রচলিত আছে “ ঊীপবংং ড়ভ ধহুঃযরহম রং াবৎু নধফ ”. পবিত্র রমজান মাসে এক শ্রেণীর লোক ইফতারের সময় প্রচুর পরিমান খাবার গ্রহণ করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। আমাদের প্রিয় নবীও (দঃ) পরিমিত খাবার গ্রহণের জন্য উপদেশ দিয়ে গেছেন। বাস্তবেও দেখা যায় যে, পরিমিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে একজন রোজাদার সারাদিন খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সুতরাং প্রত্যেক রোজদারের উচিত হবে পরিমিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে সিয়াম পালন করা। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও মন দুইই ভাল থাকবে।
পরিশেষে, মহান আল্লাহর দরবারে আকুল আবেদন, আমরা সকলেই যেন শরীর-মন সবকিছ্ইু আল্লাহর রাস্তায় নিবেদিত করার মাধ্যমে সিয়াম পালনে ব্রতী হই। পাশাপাশি রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে ও রোজাদাররা যাতে সুচারুভাবে ও সুন্দর পরিবেশে রোজা পালন করতে পারে সেদিকে প্রশাসনের নজরদারী বাড়ানো প্রয়োজন।

লেখক: কলামিষ্ট, সংগঠক ও সাবেক ছাত্রনেতা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট