চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চলে গেলেন বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের এক সেতুবন্ধ আকাশবাণীর উপেন তরফদার

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

২৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক, ভারতে বাংলাদেশের বন্ধুরা একে একে চলে যাচ্ছেন। কিংবদন্তী সম্প্রচার ব্যক্তিত্ব দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই গিয়েছিলেন, এবার গেলেন আকাশবাণী কলকাতার প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব প্রণম্য উপেন তরফদার। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর উপেন তরফদারের নাম বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরত। উপেন বাবু তখন ছিলেন কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের সহ অধিকর্তা এবং সংবাদ বিচিত্রা বিভাগের স্বনামধন্য প্রযোজক। তাঁর সংগে ছিলেন গ্রন্থণায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, লিখনে প্রণবেশ সেন ।

বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় উপেন বাবুর কাজ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি পরবর্তীকালে আকাশবাণী শিলিগুড়ির অধিকর্তা হয়েছিলেন। তাঁর সুকর্মের জন্য বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন।
তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। সর্বোপরি, তিনি ছিলেন মিষ্টভাষী। উল্লেখ্য, তাঁর ভাই ছিলেন খ্যাতনামা আলোকচিত্রী অমিয় তরফদার। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বর্তমানে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের যুগ্ম অধিকর্তা পদে থেকে সুন্দরভাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
উপেন বাবু’র জন্ম বাংলাদেশের মাণিকগঞ্জে। উঁনি আকাশবাণীতে যোগদান করেন ১৯৫৪ খৃষ্টাব্দে। গত ১৬ জানুয়ারি রাত্রে কলকাতায় পি.জি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। সেসময় ভারতই হয়ে উঠেছিলো আমাদের স্বদেশ আর আমাদের নিজের যেটা ছিলো প্রকৃত স্বদেশ, আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ, সেটা পাকিস্তানি সৈন্য কবলিত হয়ে আপন দেশটাই যেন হয়ে উঠেছিলো ‘পরদেশ’।
ভারত তখন আমাদের অভয়াশ্রম, মুক্তাঞ্চল; যার যখন প্রয়োজন পড়তো, এক দৌড়ে ভারত। পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন নেই। কেউ বাধা দেয়ার ছিলো না। সীমান্ত খোলা, বাংলাদেশ আর ভারত প্রায় একদেশ তখন। পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দালালদের অত্যাচার-নির্যাতনে স্বজনহারা, বাস্তুহারা মানুষ ভারতে গিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতো। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে অস্ত্র ও ট্রেনিং নিয়ে দেশে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরও ছিলো কলকাতায়, ভারতে।
ভারতের সাধারণ মানুষও বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যের জন্য দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছিলো। বাংলাদেশ থেকে যারা একটু আশ্রয় ও সাহায্যের আশায় তাদের স্মরণাপন্ন হয়েছে, তাদেরকে তারা জড়িয়ে ধরে বুকে ঠাঁই দিয়েছে। নয় মাস প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে শরণার্থীরা ঠাঁই করে নিয়েছিলো।

তাদের বসার, ঘর, শোবার ঘর শরণার্থীদের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়েছে, খেতে হয়েছে ভাগ করে, শরণার্থীদের কষ্ট তাদেরকে ভোগ করতে হয়েছে। শীতকালে লেপ, কাঁথা, কম্বলের টানাটানি পড়েছে। তারা সব সহ্য করেছে। কিন্তু ভারতের জনগণের এই ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার, ভারত সরকারের সাহায্য-সহযোগিতার কথা কি আমরা মনে রেখেছি ?
সুযোগ পেলেই তো আমরা ভারতকে গালাগালি করতে ছাড়ি না। অথচ পৃথিবীর আর কোন জাতি ভিন্ন জাতির জন্য এমন নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, এমন কষ্ট স্বীকার করেছে কিনা আমার জানা নেই। বাংলাদেশকে সাহায্য করার কারণে ভারতের আন্তর্জাতিকভাবে বন্ধুহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি ছিলো, বহিঃশত্রুর দ্বারা ভারতের আক্রান্ত হবার ভয় ছিলো। আক্রান্ত হয়েছেও ভারত; ৩ ডিসেম্বর ৭১ পাকিস্তান বিনা কারণে ভারতের ওপর হামলে পড়েছিলো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক সমাজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে রাজপথে সভা, মিছিল করেছেন, তহবিল সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে দিয়েছেন, সংবাদপত্রে লেখালেখি করে, বেতারে প্রবন্ধ, কবিতা, কথিকা পাঠ করে, অভিনয় করে, জয় বাংলার পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছেন।
এমনি একজন বাঙালি-প্রেমিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সোচ্চার প্রবক্তা ছিলেন উপেন তরফদার। তাঁর প্রয়াণে বাংলাদেশ একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারালো। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সেতুবন্ধ স্বরূপ ছিলেন। তথ্যসূত্র : সঞ্জয় চৌধুরী, কলকাতা।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট