চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

স্মরণ : পুঁথিসাধক ও পদকার কবি খুলন পন্ডিত

খোন্দকার মোহাম্মদ আলী

২৬ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

আগেকার দিনে ইতিহাস বলতে মানুষ মনে করতো রাজা-স¤্রাটদের দেশ বিজয়ের কাহিনীই ইতিহাস। গণমানুষের জীবন যাপনের কাহিনীও ইতিহাস হতে পারে। তাই আজকাল ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু গবেষকদের কাছে দেশকে আরোও নিখুঁতভাবে ও সম্পূর্ণভাবে জানার জন্য গুরুত্ব পাচ্ছে আঞ্চলিক ইতিহাস। এই উপলব্ধিকে সামনে রেখে বিগত দু’তিন বছরে রাউজান মোহাম্মদপুরের পুঁথিসাধক ও পদকার কবি খুলন পন্ডিত (র.) কে নিয়ে ছৈয়দ ইসমাইল হোসেন “রাউজানের ইতিবৃত্ত” তাঁর একটি বিশাল গবেষণা গ্রন্থে ও হাফেজ মাওলানা শাহ্ মোহাম্মদ নুরুল আবছার “আউলিয়া কেরামের কথা” নামক বইতে ভিন্নভাবে দুটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। এ প্রবন্ধটি এরই ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। আঠারো শতকের প্রারম্ভে বর্তমান রাউজান উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খুলন পন্ডিত (র.)। তাঁর জন্মসন কোথাও উল্লেখ নেই। তবে তিনি ইন্তেকাল করেন ১৮৮০ দশকের দিকে। তাঁর পিতার নাম তাহের মোহাম্মদ। তখন বাংলার রাজধানী ছিল গৌঁড়। ১৫৭৬ সালে মোগলড়া গৌঁড় দখল করেন। ১৫৮০-১৫৮২ পর্যন্ত বাংলার শাসক ছিলেল টোডরমল্ল। ১৫৮১ সালে স¤্রাট আকবর দ্বীনি-ইলাহী নামক এক বিচিত্র ধর্ম প্রচার করেন। ইসলামের আদর্শ বিরোধী পৌত্তলিকতায় ভরা এই ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের সাথে সাথে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানী (র.) তাঁর অনুসারী সুফিবৃন্দ, আলেম সমাজ ও অত্র অঞ্চলে বসবাসরত অলি-দরবেশগণ ক্রোধে ফুঁসে উঠেন। স¤্রাট আকবরের অত্যাচারে ভয়ে অনেকেই জুলুম থেকে রেহাই পেতে গৌঁড় ছেড়ে দলে দলে চট্টগ্রামে আশ্রয় দেন। এসময় খুলন পন্ডিত (র.) এর পূর্বপুরুষরা গৌঁড় থেকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা পাইন্দং গ্রামে স্থানান্তরিত হয়ে বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকে তাঁর পিতা তাহের মোহাম্মদ রাউজান উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে হিজরত করেন। তাঁর নামানুসারে মোহাম্মদপুরে একটি রাস্তা রয়েছে। এই রাস্তাটির নাম ১৭৬৪ সালের সিটা জরিপের রেকর্ডে তাহের মোহাম্মদ এর রাস্তা নামে জরিপের রেকর্ড করা আছে। ইহা থেকে মনে হয় তিনি ১৭৬৪ সালের পূর্বে মোহাম্মদপুরে আগমন করেছিল। ফটিকছড়ি উপজেলার পাইন্দং গ্রামে জমিদার হিসেবে তাঁরা অঢেল সম্পত্তির মালিক ও তরফ তালুকের অধিকারী ছিলেন। সে সময়ে তাঁরা সমাজের সম্মানিত লোক হিসেবে ঘোড়ায় চড়ে চলাফেরা করতেন। সম্ভবত তাঁরা আরবদেশাগত সম্ভ্রান্ত বংশের উত্তর পুরুষ হিসেবে গৌঁড়ে এসেছিলেন। খুলন পন্ডিত (র.) ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কিন্তু স্বল্প-শিক্ষিত এ ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত মেধা ও ধী-শক্তি সম্পন্ন বাংলা ও আরবী শব্দবহুল মিশ্রিত পুঁথি লেখক ও পদকার কবি। খুলন পন্ডিত (র.) এর সাহিত্যচর্চা ও জ্ঞান সাধনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবী শব্দ বহুল দোভাষী পুঁথি রচয়িতা, পুঁথিচর্চায় ছিলেন বাংলা পুঁথি সাহিত্যের বাতিঘর। তাঁর আরবী শব্দ বহুল বাংলা দোভাষী পুঁথি সহ ঐ ধরণের মোট ৪৯টি পুঁথি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে গেছেন। এছাড়া আরো কিছু পুঁথি তাঁর দৌহিত্র নুর আহম্মদ হারিয়ে ফেলেন। তাঁর রচিত কিছু পদ তাঁর পরবর্তী বংশধর জনৈক ব্যক্তির নিকট আছে বলে জানা যায়। খুলন পন্ডিত (র.) এর পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই তাদের পূর্বপুরুষের ন্যায় জ্ঞান প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে পুঁথি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও পদরচনা করে তা আবৃত্তির মাধ্যমে এলাকাবাসীকে আনন্দ দেয়ার একটি ধারা প্রচলন করেছিলেন। তাঁর অধঃস্থন বংশধরের জনৈক আলি আহমদ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কুমিল্লা রাজবাড়ীর একটি অনুষ্ঠানে ইসলামী সঙ্গীঁত তথা গজল পরিবেশন করে রৌপ্য পদক লাভ করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন বংশগত পন্ডিত। সেকালে এতদ্অঞ্চলের যেকোন জায়গায় পুঁথি পাঠের আসরে এ বংশের লোকদের ডাক পড়ত। বর্তমান মোহাম্মদপুর স্কুলের এক সময়ে এই রুপ ছিলনা। এ স্কুল প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে ১৮৯৬ সালের বা তারও আগে মোহাম্মদপুরের সুপরিচিত জনৈক এমদাদ হোসেন চৌধুরীর দাদার কাচারী ঘরে খুলন পন্ডিত (র.) এর কনিষ্ঠ পুত্র আরবার আলী ছোট শিশুদের পাঠদান করতেন। স্থানীয় লোকেরা তাকে গুরুজী বলে ডাকতেন। এই কাচারী ঘর থেকে ক্রম রূপান্তরিত হয়ে প্রথমে পাঠশালা পরে এম.ই স্কুলে পরিণত হয়। যতটুকু জানা যায় খুলন পন্ডিত (র.) এর মেয়ের ঘরের নাতি খোন্দকার জকিউদ্দিন মিয়াজী (র.) ও খুলন পন্ডিত (র.) উভয়ে হযরত সৈয়্যেদেনা খিজির (আ.) এর বাতেনী ফয়েজ প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বর্তমানে মোহাম্মদপুরে খুলন পন্ডিত (র.) এর নামে দুটি বাড়ি রয়েছে। এই দুই বাড়ির সামনে দুইটি মসজিদও রয়েছে। এই মসজিদগুলো শুরুতে খুলন পন্ডিত (র.) এর বংশধরদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে উক্ত মসজিদগুলোতে তাঁদের তেমন কর্তৃত্ব নেই। দুটি বাড়ির মধ্যে প্রথম বাড়িটি “জোতখুলন” ও দ্বিতীয় বাড়িটির কিয়দংশ “তালুক মোহাম্মদ খুলন” নামে রেকর্ডে জরিপকৃত জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই পুঁথি সাধক, পদকার কবি ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব রাউজানবাসীর অন্তর আত্মার গর্বের ধন হিসেবে অনন্তকাল চিরজাগরুক হয়ে থাকবেন।

খোন্দকার মোহাম্মদ আলী
জাতীয় পুরুষ্কার প্রাপ্ত শিক্ষাবিদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট