চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

‘গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী ইস্কুল খুইলাছে’

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ

চলরে মন ত্বরাই যাই, বিলম্বের আর সময় নাই/গাউসুল আযম মাইজভা-ারী ইস্কুল খুইলাছে’ ‘কত খেলা জানরে মওলা, কত খেলা জান…রঙিলা ভা-ারী মাওলা রে’/ দমে দমে জপরে মন-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-আধ্যাত্মিক, মারফতি ও ভা-ারী গানের তালে তালে এবং আল্লাহু আল্লাহু জিকিরে মুখরিত মাইজভা-ার দরবার শরিফ। লাখো ভক্ত, অনুরক্ত ও আশেকানের মহামিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। জাতভেদ ভুলে মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপা-নৈকট্য হাসিলের আশায় কোরআন তেলোয়াত, ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আসকারে মশগুল রয়েছেন পুণ্যার্থীরা। প্রতিবছর ১০ মাঘ মাইজভা-ার দরবার শরিফে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়

মাইজভা-ার তরিকার প্রবর্তক গাউসুল আজম হযরত শাহসুফি মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ (ক.) মাইজভা-ারীর বার্ষিক ওরশ শরীফ। এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১১৪ম ওরশ শরিফ। তরিকত-ই মাইজভা-ারী মানবতা ও মানুষের কল্যাণ-শান্তিতে নিহীত। ৮ মাঘ থেকে ওরশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। আজ ১০ মাঘ হচ্ছে প্রধান দিবস। আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে তিন দিনের মহাসম্মিলন।

চট্টগ্রাম শহর থেকে উত্তরে ২৪ কি.মি. দূরে মাইজভা-ার শরিফের অবস্থান। ফটিকছড়ির ঈছাপুর এককালে মুসলিম সৈন্য বাহিনীর খাদ্য রসদপত্রের ভা-ার ছিল। সেই ভা-ার থেকে মাইজভা-ার নামকরণ করে এখন বেলায়তের ঐশ্বর্য ভা-ারে রূপ নিয়েছে। বিশ্ব আধ্যাত্মিক পরিম-লের কেন্দ্রভূমি মাইজভা-ার শরিফ এখন ঐশীপ্রেমের মহিমায় মহিমান্বিত-দেদীপ্যমান।
ওরশ শরীফ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ ছুটে আসেন ফটিকছড়ি মাইজভা-ার শরীফে। ধনী-দরিদ্র, জাতভেদ ও ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে মানুষের ঢল নেমেছে দরবার প্রাঙ্গণে। জেয়ারত, ইবাদত, জিকির-আসকার, দোয়া-দরুদ পাঠ, মিলাদ-কিয়ামে মুখরিত দরবার শরীফ। ইবাদত বন্দিগীর মাধ্যমে প্রেমময় ¯্রষ্টার সান্নিধ্য ও সৃষ্টিকর্তাকে কৃপা লাভের আশায় লাখো মানুষ হাজির হন দরবার শরীফে। হযরত গাউসুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ (ক.) মাইজভা-ারীর মহান আদর্শকে জাগিয়ে তোলার মানসে সমবেত হয়েছেন লাখো ভক্ত ও জায়েরীন।

প্রধান দিবস উপলক্ষে মাজার সংলগ্ন বিলজুড়ে বসেছে বিশাল মেলা। বিল ছাড়াও আশপাশের সড়ক-উপ সড়কজুড়ে বসে নানা ধরনের পসরা। মাইজভা-ারের ওরশ আর গ্রামীণ মেলা হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক, ঐতিহ্যের বাহক। ২-৩ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত মেলার বিস্তৃতি লাভ করে। মেলায় কৃষিজ পণ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালি সামগ্রী, কুটির-হস্ত শিল্প, গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাঁশ-বেতের ডালা, কুলা, ছালন, মোড়া, কাঠের পিড়া, দা-বটি সবই মিলে। শুধু কি তাই, মিঠা-মুড়কি, পিঠা-পায়েস থেকে বিভিন্ন খেলনা, বাঁশের বাঁশি, মেয়েদের চুৃরি ফিতা-মেলায় কি না মিলে।
মাইজভা-ারের মেলার বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে মন কাড়ে ‘চীনা মূলা’। প্রতিটি মূলার ওজন ৫-৭ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এই মূলা বিক্রি হয়ে আসছে। চীন থেকে আনা বীজ থেকে এই মূলার উৎপাদন বলে চীনা মূলা নামকরণ হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে উত্তরে ২৪ কি.মি. দূরে মাইজভা-ার শরিফের অবস্থান। ফটিকছড়ির ঈছাপুর এককালে মুসলিম সৈন্য বাহিনীর খাদ্য রসদপত্রের ভা-ার ছিল। সেই ভা-ার থেকে মাইজভা-ার নামকরণ করে এখন বেলায়তের ঐশ্বর্য ভা-ারে রূপ নিয়েছে। বিশ্ব আধ্যাত্মিক পরিম-লের কেন্দ্রভূমি মাইজভা-ার শরিফ এখন ঐশীপ্রেমের মহিমায় মহিমান্বিত-দেদীপ্যমান।

সংক্ষিপ্ত পরিচিত : হযরত আহমদ উল্লাহ’র (ক.) পূর্বপুরুষের নবী করিম (স.) এর বংশধর। পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পীরানে পীর দস্তগীর হযরত আবদুল কাদের জিলানীর (র.) বংশধর। হযরত ইমাম হাসান (র.) ও হযরত ইমাম হোসাইনের সূত্র ধরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার সুলতানের আমন্ত্রণে তাঁর পূর্বপুরুষের রাজধানী গৌড় নগরে ইমামতি, কাজী পদে আসীন হন। ওই বংশের একজন সৈয়দ হামিদ উদ্দিন গৌড়ির রাজধানীতে কাজী পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে ঐশী নির্দেশে সৈয়দ হামিদ উদ্দিন গৌড়ি রাজধানী থেকে চট্টগ্রামে আসেন। পটিয়ার কাঞ্চননগরে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারে ওই এলাকার নাম হামিদগাঁও নামকরণ করা হয়। বর্তমানে হাইদগাঁও নামে পরিচিত। এতে বসতি স্থাপন করে আল্লাহ আর রাসুলে করিম (স.) মহিমা-মহাত্ম্য প্রচার আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর এক পুত্র সৈয়দ আবদুল কাদের মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালনে ফটিকছড়ির আজিমনগরে বসবাস করেন। ওই বংশে জন্ম নেন মাইজভা-ার তরিকার প্রবর্তক-আধ্যাত্মিক সাধক গাউসুল আজম হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী।

গাউসুল আজম মাইজভা-ারী মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ (ক.) জন্মের পর পরই ধর্মীয় রীতিতে পবিত্র শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। মাধ্যমিক শিক্ষার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য যান কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ১২৬০ হিজরীতে। ১২৬৮ হিজরীতে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কোরআন, হাদিস, তাফসির, ফেকাহসহ বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১২৬৯ হিজরী সনে বাংলাদেশের যশোরে বিচার বিভাগে কাজীর পদে নিয়োজিত হন। পরবর্তী বছরে কাজীর পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে কলিকাতার মাটিয়া বুরুজে বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুন্সী বু’আলী ও আলিয়া মাদ্রাসায় প্রধান মোদারেস হিসেবে শিক্ষতার পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই সময়ে পীরানে পীর দস্তগীর মাহবুবে সোবহানী গাউসুল আজম মহিউদ্দিন শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (ক.)-এর বংশধর ও খলিফা সৈয়দ আবু শামা মোহাম্মদ সালেহ আলকাদেরী লাহোরী (ক.)-এর কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। এবং আধ্যাত্ম্য সাধনায় নিয়োজিত হন। পীরের নির্দেশে হযরত আবু শামা (ক.)-এর অগ্রজ চিরকুমার শাহসুফি সৈয়দ দেলোয়ার আলী পাকবাজ মোজাহেরে মদনীর ফয়েজ হাসিল করেন। পাঁচ বছর পীরের সান্নিধ্যে থেকে ১২৭৫ হিজরীতে নিজ গ্রাম মাইজভা-ারে ফিরে আসেন। ধর্ম দেশনায় নিজেকে সঁপে দেন। ধীরে ধীরে তাঁর বেলায়তী ক্ষমতার দীপ্ত উদ্ভাসিত ও বিকশিত হতে থাকে। বাংলার মাটিতে প্রবর্তিত একমাত্র তরিকা হিসেবে তিনি মাইজভা-ারী তরিকার সূচনা করেন। মাইজভা-ারী তরিকার প্রবর্তক-আধ্যাত্মিক সাধক হযরত গাউসুল আজম আহমদ উল্লাহ (ক.) ৭৯ বছর বয়সে ১৯০৬ সালের ২৩ জানুয়ারি (১০ মাঘ) ওফাত হন। সেই থেকে ১০ মাঘ বার্ষিক ওরশ দিবস পালন হয়ে আসছে। ১১৩ বছর পার করছে মাইজভা-ার দরবার শরীফের প্রাণপুরুষ হযরত আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভা-ারীর ওরশ শরিক। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও পাশ্ববতী দেশ থেকেও ভক্ত-অনুরক্তরা শরিক হতে ছুটে আসেন। এই দিনে লাখো ভক্তের মিলনমেলা ঘটে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট