চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

সরকারি পাহাড় কেটে আবাসন প্রকল্প

কক্সবাজার ৩৩ একর জমিতে ‘প্লট’ তৈরি ও বিক্রি

আরফাতুল মজিদ, কক্সবাজার

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:০১ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার শহরের কলাতলী সৈকতপাড়াস্থ লাইট হাউস এলাকায় ৩৩ একরের একটি বিশাল সরকারি পাহাড় দখল করে সেখানে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছেই ‘লাইট হাউস সার্বিক গ্রাম পল্লী উন্নয়ন সমবায় সমিতি লি.’ নামে একটি সমিতির নেতারা। জেলা প্রশাসনের অগোচরে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত ভূমিদস্যু দৃশ্যহীন সমিতির ব্যানারে আবাসন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে যাচ্ছেন। পাহাড় কেটে তৈরি করছেন প্লটও। গত একবছর ধরে সরকারি পাহাড় কেটে তৈরি করা প্লটগুলো সমানতালে বিক্রিও চলছে। ইতোমধ্যে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকাও।

‘লাইট হাউস সার্বিক গ্রাম পল্লী উন্নয়ন সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি আব্দুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন, কোষাধ্যক মোবারাক আলী ও হাজি জসিমের নেতৃত্বে সরকারি এই বিশাল পাহাড়টি দখল করে প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার পূর্বকোণকে বলেন, ‘লাইট হাউজ এলাকায় সরকারি বিশাল পাহাড় কেটে প্লট আকারে একটি ভূমিদস্যু চক্র বিক্রি করছে বলে শুনেছি। অবৈধভাবে সরকারি এই পাহাড়টি দখলের পর বিক্রিতে বেশ কয়েকজনের নামও পাওয়া গেছে। দ্রুতসময়ে সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দখল ও বিক্রির সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সদর ইউএনও এবং এসিল্যান্ডকে বলা হয়েছে। কোনভাবেই এসব অপরাধীদের ছাড় দেয়া হবে না’।
এর আগেও ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর সেখানে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল প্রশাসন। এ সময় ওই পাহাড় কেটে অবৈধভাবে নির্মিত শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল।

গত ২১ জানুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, কলাতলী সুগন্ধা পয়েন্টের পূর্বপাশে লাইট হাউজ ও সৈকত পাড়া মিলে প্রায় ৯০ একরের একটি বিশাল পাহাড় রয়েছে। এরমধ্যে ৩৩ একরের মতো পাহাড় দখল করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে এই সমিতির লোকজন। গত তিনবছর ধরে পাহাড়টি দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আব্দুন রহমান ও মোবারক আলী। তারা পাহাড়টি কেটে দুই গ-া করে শতাধিক প্লটও তৈরি করেছেন সেখানে। এরপর তৈরি হয় ঘর। বর্তমানেও সেখানে পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ চলছেই। সেখানে প্লট বিক্রির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিউদ্দিন নামের একব্যক্তি। মহিউদ্দিনের বাড়ি চকরিয়া উপজেলায়। তিনি চকরিয়া ইউসিবিএল ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলে জানা গেছে।
ওই পাহাড়ে সম্প্রতি প্লট ক্রয় করেন টেকনাফ শামলাপুর এলাকার আব্দুর রহমান নামে একব্যক্তি। তিনি জানান, মহিউদ্দিন নামে একব্যক্তির কাছ থেকে গ-াপ্রতি ৭০ হাজার টাকা ধরে তিন প্লটে ৬ গ-া জায়গা নিয়েছেন। বর্তমানে সেখানে ঘর তৈরি করার জন্য অল্প করে পাহাড় কাটা হচ্ছে।
এরপাশে আরো ৬ গ-া পাহাড়ি জায়গা ক্রয় করেন সাফা নামের একব্যক্তি। তিনি কলাতলীর একটি হোটেলের ম্যানেজারও। তিনি জানান, গ-া প্রতি ১ লাখ করে তিনিও তিন প্লটে ৬ গ-া জায়গা কিনেছেন মহিউদ্দিনের কাছ থেকে। বর্তমানে সেখানে ঘর তৈরি করা হয়েছে। একইভাবে হেলাল নামে এক এনজিওকর্মীও দুই প্লটে ৪ গ-া জমি কিনেছেন মহিউদ্দিনের কাছ থেকে। চকরিয়া এলাকার রফিক নামে একব্যক্তিও জমি কিনেছেন মহিউদ্দিনের কাছ থেকে। রফিক পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত বলে জানা গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে মহিউদ্দিন বলেন, আমি ‘লাইট হাউস সার্বিক গ্রাম পল্লী উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হলেন কক্সবাজার শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আব্দুর রহমান। গত একবছর আগে মোবারক আলীর কাছ থেকে ওই পাহাড়ে অনেকগুলো জমি কিনেছি আমি। এই সমিতিতে প্রায় ৮৩ জন সদস্য জড়িত রয়েছে। তাছাড়া পাহাড়টি বন্দোবস্তি নেয়ার জন্য আবেদনও করেছি মন্ত্রণালয়ে’। মন্ত্রণালয় থেকে এই সংক্রান্ত কাগজও জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিস কার্যালয়ে এসেছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে একপর্যায়ে তিনি এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। এমনকি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তারা ঝামেলায় পড়বেনও বলেও স্বীকার করেন।

জানতে চাইলে মোবারক আলী জমি দখলের বিষয়টি স্বীকার করে দাবি করেন, গত দেড় বছর আগে যখন ওই সরকারি পাহাড়ে প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালায় তখনই এসব জমি ফেলে চলে আসি। আমরা যারা ছিলাম তারা আর যায়নি সেখানে। মহিউদ্দিনকে জমি বিক্রি করার বিষয়টি সত্য নয়।
ওই পাহাড়ে প্লট রয়েছে এমন কয়েকজন ব্যক্তি জানিয়েছেন, মোবারক আলী, আব্দুর রহমান ও হাজি জসিম আড়ালে থেকেই বর্তমানে ওই পাহাড়ের প্লটগুলো বিক্রি করে যাচ্ছেন। এইক্ষেত্রে দখল করা পাহাড়ের একটি অংশ বিক্রি করা হয়েছে মহিউদ্দিনের কাছে। এরপর মহিউদ্দিন তার নিজের ইচ্ছামতো বিক্রি করছেন সরকারি পাহাড়। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর অভিযান হওয়ার পর থেকেই মহিউদ্দিনকে সামনে দিয়ে সরকারি পাহাড়টির দখল আকড়ে রেখেছেন তারা। বর্তমানে সেখানেÑ মোবারক আলী, আব্দুর রহমান, ফারুক, মোহাম্মদ আলী, হাজি জসিম ও রিয়াজসহ অনেকজনের দখলীয় প্লট রয়েছে। এসব প্লটে বসতঘর তৈরি করে কিছু রোহিঙ্গা পরিবারকে কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়োজিত করেছেন। আবার অনেক প্লটে এখনো ঘর তৈরি করা হয়নি। অনেকেই পাহাড় কেটে যাচ্ছে ঘর তৈরি করতে। পাহাড়ের মাঝখানে প্লটে যেতে তৈরি করা হয়েছে আঁকাবাঁকা রাস্তাও। পাহাড় কেটেই রাস্তাটি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগও। এদিকে হাজি জসিম ওই পাহাড়ে তার কোন জমি নেই বলে দাবি করেন। কিন্তু কয়েক দিন আগেও হাজি জসিম তার জমিতে যান বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাফুজুর রহমান জানান, সরকারি পাহাড় দখল করে বিক্রি করার কোন সুযোগ নেই। দ্রুতসময়ে বিষয়টি দেখে শুনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার জানান, সৈকত তীরে খাসজমির এ পাহাড়ের মালিক সরকার। কিন্তু প্রশাসনের অগোচরে সরকারি এ পাহাড়ের জমি দখল করে বিভিন্ন ব্যক্তি। লাইট হাউস সমবায় সমিতির আবাসন প্রকল্পের নামেও পাহাড়টিতে স্থাপনা নির্মাণ করে সংঘবদ্ধ চক্র। কোন মন্ত্রণালয় থেকে পাহাড়ে কাউকে জমি দেয়ার বিষয়ে নির্দেশনা আসেনি। হয়ত নিজেদের দখল প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে দখলকারীরা গুজব ছড়াচ্ছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট