চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পাঁচ পুলিশ সদস্যের ফাঁসি

‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ মামলার রায় হ ‘এটা যে গণহত্যা সেটা রায়ে প্রমাণ হয়েছে। এতদিন পর আমরা দায়মুক্ত হলাম’ হ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রায় ঘোষণা, আমাদের কাছে বিষয়টি ঘোলাটে’

নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

লালদিঘি মাঠে জনসভায় যাবার পথে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় দায়ের করা ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ মামলার রায় হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় অভিযুক্ত থাকার অপরাধে তৎকালিন পাঁচ পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত।

গতকাল (সোমবার) বিভাগীয় বিশেষ জজের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ ইসমাইল হোসেন এ রায় দেন।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি নগরীর লালদিঘি ময়দানে সমাবেশে যাবার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালালে নিহত হন ২৪ জন। আহত হন কমপক্ষে দু’শতাধিক মানুষ। ঘটনাটি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিরা হলো, কোতোয়ালী থানার তৎকালীন পেট্রল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র ম-ল (মামলার বিচার শুরুর পর থেকেই পলাতক), সাবেক পুলিশ কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, মো. আব্দুলাহ এবং মমতাজ উদ্দিন। চার আসামিকে রায় ঘোষণার সময় কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। পরে তাদের আবারও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। দ-বিধির ৩০২ ধারায় আসামিদের মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। এছাড়া দ-বিধির ৩২৬/৩৪ ধারায় প্রত্যেকের আরও দশ বছর করে কারাদ- দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্ত প্রথম আইনজীবী
স্বভু প্রসাদ বিশ্বাস বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ মামলায় আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন। এটা যে গণহত্যা ছিল সেটা আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়েছে। এতদিন পর আমরা দায়মুক্ত হলাম’।

পুলিশের গুলিতে নিহতরা হলেন, হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম. স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবারট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চাঁন্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও মো. শাহাদাত। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে প্রয়াত আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদি হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হত্যাকা-ের সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের দায়িত্বে থাকা মীর্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়। এতে রকিবুল হুদাকে ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বহুল আলোচিত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের নির্দেশে সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রথম দফায় ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাকে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে মীর্জা রকিবুল হুদাসহ ৮ পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। অভিযুক্ত অন্যরা হলেন, কোতোয়ালী জোনের তৎকালীন পেট্টল ইন্সপেক্টর (পিআই) জে সি মন্ডল, পুলিশ কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, মো.আব্দুলাহ এবং মমতাজ উদ্দিন।

আসামিদের মধ্যে রকিবুল হুদা, বশির উদ্দিন ও আব্দুস সালাম মারা গেছেন। জে সি ম-ল পলাতক, বাকি চারজন আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে আসছিলেন। আদালতে দুই দফায় আলোচিত এ মামলার চার্জ গঠন (দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত আকারে) করা হয়। প্রথম দফায় ১৯৯৭ সালের ৫ আগস্ট এবং দ্বিতীয় দফায় ২০০০ সালের ৯ মে ৮ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলার মোট সাক্ষী ১৬৭ জন। গত ১৪ জানুয়ারি ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য কার্যক্রম শেষ হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ড. অনুপম সেন, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন ও হেলাল উদ্দিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী মামলায় সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত রবিবার (১৯ জানুয়ারি) রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন। গতকাল (সোমবার) আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপনে অসম্মতি জানান।

মামলার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কারাগারে থাকা চার আসামির আইনজীবী সাঈদ আহসান। তিনি বলেন, ‘আমরা এই আদালতের ওপর অনাস্থা এনে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২৬ ধারায় একটি আবেদন করেছিলাম যে, আমরা উচ্চ আদালতে যাব। সেজন্য আমরা যুক্তিতর্কে অংশ নিইনি। কারণ, ১৯৮৮ সালে ঘটনার পর একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়েছিল। সেই তদন্ত প্রতিবেদন মামলার ডকেট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা বিষয়গুলো আদালতের নজরে এনেছিলাম। এরপরও একদিনের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ করে একদিনও সময় না নিয়ে আমাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে বলা হয়। আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রায় ঘোষণা করা হল। এই তড়িঘড়ির কারণে আমাদের কাছে বিষয়টি ঘোলাটে মনে হচ্ছে’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট