চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আদালতের পর্যবেক্ষণ এটি পরিকল্পিত গণহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

তিন দশক পর প্রমাণিত হয়েছে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে উত্তাল গণআন্দোলনের মধ্যে পুলিশ একটি গণহত্যার পরিকল্পনা করেছিলো। ঘটনার ৩২ বছর পর আদালতে তা প্রমাণিত হয়েছে।

এই মামলার রায়ে আদালত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, এটি ছিল গণহত্যা। চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের তৎকালিন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে এবং কোতোয়ালী থানার পেট্টল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র ম-লের হুকুমে এই হত্যাকা- হয়েছে বলে আদালত রায়ে উল্লেখ করেছেন। গতকাল (সোমবার) বিভাগীয় বিশেষ জজের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্ত মামলার প্রথম কৌঁসুলী স্বভু প্রসাদ বিশ্বাস বলেন, ‘আদালত বলেছেন পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার উদ্দেশে জনগণের ওপর আঘাত করা হয়েছে। ঘটনার একদিন আগে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের ২৩ জানুয়ারি এই ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত বলেছেন, এটি পরিকল্পিত গণহত্যা’।
আলোচিত এই মামলায় রায়ের শুধু সারসংক্ষেপ পাঠ করেছেন আদালত। সার সংক্ষেপে আদালত বলেন, ‘চট্টগ্রামের তদানীন্তন মেট্টোপলিটন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা কর্তৃক ওয়াকিটকির মাধ্যমে প্রদত্ত অবৈধ নির্দেশে কোতোয়ালী থানার পলাতক আসামি গোবিন্দ চন্দ্র ম-ল ওরফে জে সি ম-লের অবৈধ হুকুমে আসামিগণ এলোপাতাড়ি রাইফেলের গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। উক্ত আসামির নির্দেশে নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে মিছিলকারীদের মধ্যে ২৪ জন মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে হত্যাকা- সম্পর্কিত সাক্ষ্যপ্রমাণাদি গোপন ও বিনষ্ট করার জন্য নিহতদের মৃতদেহ ধমবর্ণ নির্বিশেষে অনেক মুসলিম ও হিন্দুদের তাদের আত্মীয়স্বজনের অগোচরে কোতোয়ালী থানার অর্ন্তগত অভয়মিত্র শ্মশানঘাটে পুড়িয়ে ফেলে’।

সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, ‘ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে আসামি গোবিন্দ চন্দ্র ম-ল, প্রদীপ বড়–য়া, শাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর বিনা উস্কানিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত, শত নিরীহ লোককে আহত ও পঙ্গু করে’।
রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেন, ‘এটা গণহত্যা। বিভিন্ন কারণে এই মামলা বিঘিœত হয়েছে। ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকে ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গায় পথসভা করতে করতে লালদিঘির দিকে আসছিলেন। লালদিঘির মাঠে ছিল তৃতীয় কর্মসূচি এবং চতুর্থ কর্মসূচি ছিল পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়। ওইসময় পুলিশ তিনটি ব্যারিকেড দেয়। একটি ছিল লালদিঘিতে, একটি কোতোয়ালীর মোড়ে এবং আরেকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে। কোতোয়ালীতে প্রথম ব্যারিকেড সরিয়ে গাড়িবহর এগিয়ে যাবার পর জে সি ম-ল ওয়াকিটকিতে বলেন, চলে আসছে। তখন পুলিশ কমিশনার ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেন, হামাইয়া দাও, গুলি করে শোয়াইয়া দাও। কমিশনারের নির্দেশে গুলিতে ২৪ জন নিরীহ ছাত্র-জনতা মারা যান। শেখ হাসিনাকে আইনজীবীরা উদ্ধার করে আদালত ভবনে নিয়ে যান’।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তার কারণে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘চার জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পরিষ্কার হয়েছে, কোনো ধরনের সহিংস ঘটনার আগেই হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে’।

এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা (বর্তমানে প্রয়াত) বাদি হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে মামলাটির কোনো অগ্রগতি হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি বিচারের পথে এগোয়।

আদালতে দুই দফায় আলোচিত এ মামলার চার্জ গঠন (দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত আকারে) করা হয়। প্রথম দফায় ১৯৯৭ সালের ৫ আগস্ট এবং দ্বিতীয় দফায় ২০০০ সালের ৯ মে ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ফের ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি আবারও গতি হারায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়। এরপরও ২০১৬ সাল পর্যন্ত মামলাটি চলছিল ঢিমেতালে। ওই বছর মামলাটি বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসে। ওই আদালতের পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর তৎপরতায় সাক্ষ্যগ্রহণের কার্যক্রমে গতি আসে। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শিক্ষাবিদ ড.অনুপম সেন, সাংবাদিক নেতা অঞ্জন কুমার সেনসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই আদালতে বিচারকাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়।

মামলার মোট সাক্ষী ১৬৭ জন। গত ১৪জানুয়ারি ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য কার্যক্রম শেষ হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত রবিবার (১৯ জানুয়ারি) রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন। গতকাল সোমবার আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করার কথা ছিল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট