চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রূপসার ‘হাতি’ হওয়ার গল্প

দেড় লাখ গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা জমা রূপসায় # ইপিজেড শ্রমিকদের টার্গেট করে গড়ে ওঠেছে অর্ধশত সমিতি # মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ সমবায় অফিসারদের বিরুদ্ধে

আল-আমিন সিকদার

১৬ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:২১ পূর্বাহ্ণ

নগরীর ইপিজেড এলাকায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষের বসবাস। চট্টগ্রামের অন্যান্য সব এলাকা থেকে এখানে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে এই এলাকায় গড়ে ওঠেছে দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। কাজের সুবাদে এসব শ্রমিক এ এলাকার আশপাশেই বসবাস করছে। আর এই দুই ইপিজেডে কর্মরত তিন লক্ষ শ্রমিকদের টার্গেট করে এখানে গড়ে ওঠেছে প্রায় অর্ধশত সমবায় সমিতি। এদের মধ্যে একটি ‘রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’। যেখানে প্রায় দেড় লাখ গ্রাহক অধিক লাভের ফাঁদে পড়ে জমা রেখেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডের ঠিক বিপরীত দিকে চৌধুরী মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় দুটি দোকান ভাড়া নিয়ে শুরু হয় রূপসার কার্যক্রম। শুরুতেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের টার্গেট করেন তারা। নেন অধিক লাভের প্রলোভনের কৌশল। জমানো টাকার ওপর ১০ শতাংশ আর স্থায়ী আমানতের ওপর ১৩-১৫ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার ঘোষণা দেন তারা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাছে জমাকৃত টাকার ওপর মুনাফার এ কথা পৌঁছে দিতে আরও অভিনব কৌশল গ্রহণ করেন তারা। শুধু তাই নয়, একজন গ্রাহক যদি অন্য একজন গ্রাহককে এই সমিতির অন্তর্ভুক্ত করেন তাকেও নতুন সদস্যের জমাকৃত অর্থের ১০ শতাংশ অর্থ দেওয়া হত। আর রূপসার এ ফাঁদে পা দিয়েছেন সাধারণ শ্রমিকরা। মুনাফার লোভে নিজের সবটুকু জমা রাখার পাশাপাশি বাড়তি টাকার লোভে অন্যকেও এই সমিতির গ্রাহক বানিয়েছেন এসব শ্রমিক। সমিতিটিতে গ্রাহক সংগ্রহের কাজ করে প্রায় দেড় হাজার কর্মী। আর এ কৌশলেই ‘টাকার সাগর’ হয়ে উঠেছে সমিতিটি। দুই কামরা থেকে এখন ওই মার্কেটেরই দুটি ফ্লোর তাদের। টাকা গ্রহণ ও প্রদানের জন্য ব্যাংকের মত রাখা হয়েছে ক্যাশ। টাকা জমা রাখার জন্য রয়েছে ভল্ট। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ এখন হাজার কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে আরো ওঠে এসেছে, সমিতিটিতে দেড় লাখ গ্রাহকের বেশিরভাগই তাদের পরিশ্রমের টাকা ফিক্সড ডেপোজিট করেছেন। ৩০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা করে ফিক্সড ডেপোজিট করেছেন গ্রাহকরা। অভিযোগ ওঠেছে, সমবায়ের অডিট অফিসারদের ও সমবায় অফিসে মাসোহারা দিয়ে এ কার্যক্রম চালিয়ে যেত সমিতিটি। প্রশাসন আর সমবায় অফিসের কিছু কর্মকর্তার মাসিক মাসোয়ারার বদৌলতে ‘রূপসা’ রীতিমতো টাকার সাগরে পরিণত হয়েছে।

এদিকে মাসোহারা নেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও রূপসার কার্যক্রম অবৈধ ছিল বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম থানা সমবায় অফিসার (ডবলমুরিং) সুমিত কুমার দত্ত। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘সমবায় সমিতিতে স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডেপোজিট) রাখার নিয়ম নেই। তাছাড়া আমাদের অডিট হিসেবে সমিতিটিতে মোট সম্পদের পরিমাণ রয়েছে ২৩ কোটি টাকার। হাজার কোটি টাকার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তারাও আমাদেরকে দেয়নি। আমরা তদন্ত করছি। যদি কোন অডিট অফিসারের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে এই সমিতিটিকে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার তথ্য পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পূর্বকোণের অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে আসে, এই রূপসা ঢাকা থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে এসেছে। যার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সমিতিটিতে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অভিযানে জব্দ করা হয়েছে ৮ কোটি সাড়ে ৪২ লাখ টাকা। আটক করা হয়েছে সমিতির পরিচালনায় থাকা মুসা হাওলাদার, রাসেল হাওলাদার ও গোলাম ফয়সাল নামে তিন সদস্যকে।

আর এ ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে সমিতিটিতে টাকা জমা রাখা গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। টাকা তুলতে গতকাল বুধবার সকাল থেকে সমিতি কার্যালয়ে ভিড় জমাতে থাকেন তারা। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডেপোজিট) যারা রেখেছেন তাদের টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করে সমিতি কর্তৃপক্ষ।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, ৮টা থেকে রূপসা মাল্টিপারপাসে কর্মস্থলে না গিয়ে জামানতের টাকা ফেরত নিতে ভীড় জমায় সহ¯্রাধিক মানুষ।
গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ গ্রাহক আর এই প্রতিষ্ঠানে জামানত রাখতে চান না। তারা সকল ডিপিএস, এককালীন এফডিআর ও বীমার মূল টাকা ফেরত চান। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডেপোজিট) যারা রেখেছেন তাদের টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন সমিতি কর্তৃপক্ষ। এসময় টাকা ফেরত না পেলে সেখান থেকে না ফেরার ঘোষণা দেন গ্রাহকরা।

এদিকে গ্রাহকদের উত্তেজিত না হতে অুনরোধ করতে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট ইপিজেড থানার অফিসারদের। ঘটনাস্থলে থাকা ইপিজেড থানার পরিদর্শক ওসমান গণি পূর্বকোণকে বলেন- ‘প্রতিষ্ঠানটি চালু আছে। কিন্তু গ্রাহকরা বন্ধ হওয়ার ভয়ে টাকা ফেরত নিতে হাজির হয়েছেন। সবাই একসাথে টাকা ফেরত চাওয়াতে উত্তেজনামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সমিতির পরিচালকরা আমাদের জানিয়েছেন- সকলের টাকা মেয়াদ অনুসারে তারা ফিরিয়ে দিবেন। মেয়াদের আগে টাকা তুলতে সমিতির নিয়ম অনুসারে সবাইকে আবেদন করতে হবে বলেও জানিয়েছেন সমিতির এমডি জাকির হোসেন। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তাদের লেনদেনও স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।’ এছাড়া রূপসা মাল্টিপারপাস প্রতিষ্ঠানের উদ্ধার হওয়া টাকা থানায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।

যে কারণে রূপসায় ডিবির অভিযান : ঢাকার পল্টন থানাধীন সার্কুলার রোড এলাকার শতাব্দী সেন্টারের ১৮ তলায় অফিস রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর এই অফিসের মালিকসহ পাঁচজন সঞ্চয় প্রকল্প দেখিয়ে দুই গ্রাহকের এক কোটি টাকা ১০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বরাবর এ অভিযোগ প্রদান করেন ফারহানা ইয়াছমিন কুয়াশা।

অভিযোগে সূত্রে জানা যায়, রূপসা সমিতির মালিক মো. মজিবর রহমান, মো. জাকির হোসেন হাওলাদার, মো. রাসেল হাওলাদার, মো. এজাজুল খান ও মূসা হাওলাদার নামে পাঁচ ব্যক্তি মুনাফার লোভ দেখিয়ে ফরিদা ইয়াছমিন ঝুমার কাছ থেকে ৩৫ লাখ ও এনামুল হক এনামের কাছ থেকে ৭৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আর এ অভিযোগের প্রেক্ষিতেই মঙ্গলবার চট্টগ্রাম রূপসা অফিসে অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

 

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট