চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সীতাকু-ে স্ক্র্যাপ জাহাজে বিস্ফোরণ

দুই শ্রমিকের মৃত্যু ৫ জন অগ্নিদগ্ধ

নিজস্ব সংবাদদাতা , সীতাকু-

১৬ মে, ২০১৯ | ৩:০৪ পূর্বাহ্ণ

সীতাকু-ের বারআউলিয়ায় একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজে বিষাক্ত গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিকা-ে দুই শ্রমিক নিহত ও আরো অন্তত ৫ শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। আহতদের মধ্যে দুই জনের অবস্থা আশংকাজনক। তারা চমেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বারআউলিয়া সাগর উপকূলে এঘটনা ঘটে। এদিকে ইয়ার্ডে অগ্নিকা-ের পর সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশে কঠোরভাবে বাধা দেয় ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ। তারা হতাহতের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি করতে থাকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বুধবার সকালে বারআউলিয়ার মো. নুরুন্নবী মানিকের মালিকানাধীন মাহিনুর শিপ রি-সাইক্লিং শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কোরিয়ান অয়েল ট্যাংকার এমটি কেলানা ফোর নামক স্ক্র্যাপ জাহাজে কাটিংয়ের কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। তারা গ্যাস দিয়ে কাটিং করার সময় হঠাৎ সেখানে বিষাক্ত গ্যাসের লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে কর্মরত এক শ্রমিক হামিদুল (৩০) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তিনি নওগাঁ জেলার নিনদই গ্রামের আনিসুল ম-লের ছেলে। এছাড়া বেশ কয়েকজন শ্রমিক গুরুতর দগ্ধ হন। তাদের চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে মো. রুবেল (২৭) নামের আরো এক শ্রমিক মারা যান। তিনি ফেনীর দেওয়ানপুর এলাকার শেখ আহমদের ছেলে। এছাড়া আহত হয়েছেন নওগাঁর মান্দা পাইকপাড়ার গিয়াস সর্দারের ছেলে মো. মাসুদ (১৯), একই এলাকার মো. খোকার ছেলে মো. সোহেল (২২), রাজশাহী পুটিয়ার হযরতের ছেলে আল আমিন (২৭), নওগাঁ সদরের মো. কামরুল (২৮) এবং সীতাকু-ের বারআউলিয়ার মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে মামুনুল ইসলাম মামুন (৩২)।
কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার আব্দুল্লাহ হারুন পাশা জানান, ওই শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজে অগ্নিকা-ের পর আমরা সেখানে গেলে কর্তৃপক্ষ জানায় ৬ শ্রমিক দগ্ধ হয়েছে। তাদের চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে রুবেলের মৃত্যু হয়। দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছি। তবে হতাহতের সংখ্যা এর চেয়েও বেশি বলে শোনা যায়। কিন্তু আমরা ঘটনার পর সেখানে যাওয়ায় কাউকে পাইনি। তার আগেই সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
অন্যদিকে গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় যে ইয়ার্ডে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটির বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা মাহিনুর শিপ রি-সাইক্লিং ইয়ার্ড। কিন্তু ওই ইয়ার্ডে যে জাহাজটি কাটিং করা হচ্ছিল সেটি আমদানি করা হয়েছিলো প্রিমিয়াম ট্রেন কর্পোরেশন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের নামে। বিষয়টি জানতে ইয়ার্ডে প্রবেশ করতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় অনুমতি না দিয়ে সাংবাদিকদের বাইরে দাড় করিয়ে রাখেন। এসময় কোন সাংবাদিক থানার ওসির সহযোগিতায়, কেউবা শিপব্রেকিং এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে তাদের মাধ্যমে ইয়ার্ডে প্রবেশের অনুমতি পান। দুর্ঘটনার পর ইয়ার্ডে প্রবেশে এত লুকোচুরিতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্ঘটনার সময় স্ক্র্যাপ জাহাজটিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি, প্রিমিয়াম ট্রেড কর্পোরেশনের নামে আনা জাহাজ মাহিনুর শিপ রি-সাইক্লিং ইয়ার্ডে কাটিং করা, হতাহত শ্রমিকের তথ্য গোপন ও সেসময় উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকদের সাথে সাংবাদিকদের মুখোমুখি না করতেই ইয়ার্ডের কর্মকর্তারা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেন। দৈনিক প্রথম আলোর সীতাকু- প্রতিনিধি কৃষ্ণ চন্দ্র দাস ও দৈনিক আজাদীর প্রতিনিধি লিটন কুমার চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, তারা এ দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহে ঘটনাস্থলে গেলেও ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সেখানে প্রবেশের করতে দেয়নি। পরে এ প্রতিবেদকও দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজটির ছবি তোলায় অসৌজন্যতামূলক আচরণ করেন ইয়ার্ডের সেফটি ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা সাব্বির চৌধুরী। এদিকে মাহিনুর শিপ রি-সাইক্লিং এ দুর্ঘটনা ঘটলেও এটি প্রিমিয়াম ট্রেড কর্পোরেশন বলে চালানো হচ্ছে কেন জানতে চাইলে সেফটি ম্যানেজার সাব্বির বলেন, মাহিনুর ইয়ার্ডটির অনুমোদন নেই। তাই প্রিমিয়ামের জাহাজ কাটা হয়। তিনি বলেন প্রিমিয়াম ট্রেড কর্পোরেশন একই মালিকের পাশ্ববর্তী প্রতিষ্ঠান। জানা যায়, মূলত একসময় এটি প্রিমিয়াম ট্রেড কর্পোরেশন নামে পরিচালিত হতো। প্রিমিয়াম ট্রেডের নামে ব্যাংক লোন থাকায় নতুন করে লোন পেতে কর্তৃপক্ষ এই ইয়ার্ডটির মাঝখানে আলাদা সীমানা করে এক অংশের নাম মাহিনুর শিপ রি সাইক্লিং করেন। সেখানেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে সীতাকু- উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন রায় ইয়ার্ড সেফটি ম্যানেজার সাব্বির চৌধুরীর কাছে জানতে চান অগ্নিকা-ের সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তা দুর্বল ছিলো কেন ? কেন এতজন শ্রমিক দগ্ধ হলো। এসময় জবাবে সাব্বির চৌধুরী বলেন, আসলে আগুন থেকে রক্ষার মত তেমন সেফটি পোশাক না থাকায় কিছু করার থাকে না।
অন্যদিকে সকালে দুর্ঘটনার পর ব্যাপক লুকোচুরির মাধ্যমে ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ হামিদুল নামক এক শ্রমিকের মৃত্যুর কথা সাংবাদিক, পুলিশসহ প্রশাসনের সকলের কাছে গোপন রাখে। কিন্তু দুপুরের পর ওই শ্রমিকের স্বজনরা ইয়ার্ডে গিয়ে তাদের লোক সেখানে আছে বলে চাপাচাপি শুরু করলে শেষে পুনরায় গিয়ে জাহাজের একটি কক্ষ থেকে তার লাশ বের করা হয়। এদিকে যে কেবিনে অগ্নিকা- হয়েছিলো সেখানে ফায়ার সার্ভিসের তল্লাশির পরও একটি লাশ অন্য কক্ষে পাওয়ায় এটি ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষই অন্য কক্ষে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নইলে যে কক্ষে আগুন লেগেছে সেখানেই লাশটি থাকার কথা।
সীতাকু- থানার ওসি মো. দেলওয়ার হোসেন দুইজন নিহতের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ওই ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে দুইজন। সকালে কর্তৃপক্ষ একজন মারা গেছে ও ৫ জন দগ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছিলো। দুপুরের পর খবর পাই যে আরো একজন শ্রমিকের লাশ পাওয়া গেছে। সেটি জাহাজের অন্য একটি কক্ষে পড়েছিলো। লাশটি উদ্ধার করে পোস্টমর্টেমের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক মাইদুল ইসলাম বলেন, যেখানে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে সেটি এমন একটি কেবিন যেখানে উঠতে গেলে মই জাতীয় কিছু অথবা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ঐ কক্ষে গ্যাস জমে থাকা একটি পাইপে বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়ায় সেখানে সব শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়। তিনি বলেন, তবে সেখানে একাধিক শ্রমিক মারা যাবার অবস্থা ছিলো। কিন্তু আমরা তো অনেক দেরিতে পৌঁছেছি। তাই সব তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। সীতাকু- উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন রায় বলেন, এত বড় একটি দুর্ঘটনার পরও তারা আমাকে কোন খবর দেয়নি। ঘটনাটি লুকানোর চেষ্টা হয়েছে সম্ভবত। আমি রাত ৯টা পর্যন্ত জেনেছি একজন মারা গেছে। পরে জানলাম দুই জন। এসব নিয়েও কেন গোপনীয়তা বুঝতে পারছি না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট