চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

যুদ্ধকালীন কমান্ডার নুরুল আলম

পাক হানাদারদের বিদ্যুৎহীন করতে গুমাইবিলে ধ্বংস করা হয় ৩টি সঞ্চালন টাওয়ার

কে. জি. ইসলাম হ রাঙ্গুনিয়া

১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:১৩ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট দেয়া ছিল বিস্ফোরকের সাহায্যে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করা। হানাদার পাকিস্থানি বাহিনী যাতে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এর সুবিধা না পায়। কিন্তু পাকসেনা পরিবেষ্টিত কাপ্তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে ধ্বংস করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। গোপন অনুসন্ধান এবং রেকি করে জানা যায়, সশস্ত্র পাক আর্মিরা তিন স্তরে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। এ বেষ্টনি ভেদ করে অপারেশন করতে হলে আত্মঘাতি টিম গঠন করতে হবে। তার উপর সফল হওয়ার সম্ভাবনাও কম। সহযোদ্ধা ও রেকি টিমের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয় দক্ষ হাতে রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে বিদ্যুৎ সাপ্লাই মেইন লাইনের পর পর ৩টি বিদ্যুতিক টাওয়ার বিস্ফোরকের মাধ্যমে ধ্বংস করা গেলে কাপ্তাই প্রজেক্ট হতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং হানাদারদের কাছে বিদ্যুৎ সুবিধা বন্ধ করার উদ্দেশ্যও সফল হবে।

তাছাড়া ভবিষ্যতে দেশ স্বাধীন হলে এ প্রজেক্টটি দেশের সম্পদ হিসেবে থেকে যাবে। যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার মরণপণ প্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়ে অপারেশন এলাকায় আসার পর প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে ট্রেনিং হতে প্রাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে টার্গেট সম্বদ্ধে অনুসন্ধান ও খরবাখরব সংগ্রহে কোনো রকম ক্রটি রাখা হয়নি। যাতে প্রথম অপারেশনে শতভাগ সফলতা পাওয়া যায়। অপারেশনের তারিখ ও সময় ঠিক করা হয় পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের প্রথম প্রহর অর্থাৎ ১৪ আগস্ট এর প্রথম প্রহর রাত ১টা। টার্গেট রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলের মাঝে কাজীর দিঘি সংলগ্ন অন্তত ২/৩ ফিট পানিতে ভিত ডুবে থাকা ৩টি বৈদ্যুতিক টাওয়ার প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ কে-১ বিস্ফোরকের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়া। এই কথাগুলো বলেছেন ১৯৭১ সালে রাঙ্গুনিয়ায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক এআইজিপি মো. নুরুল আলম।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার খিলমোগল গ্রামের আলহাজ মাস্টার আবদুল গণি তালুকদার ও নুরুন্নাহার বেগমের প্রথম সন্তান মো. নুরুল আলম ১৯৪৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। রাজশাহী কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিদ্যায় (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। রাজশাহীতে পড়ালেখাকালিন সময়ে রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করার জন্য ৭১ এর শ্বাসরুদ্ধকর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে তিনি রাঙ্গুনিয়া থানা কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

যুদ্ধকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য অপারেশনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল আলম বলেন, গুমাই বিলের ৩টি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ধ্বংস করার জন্য ১৬ জনের ১টি অপারেশন টিম নির্দিষ্ট করা হলো। টিম লিডারের দায়িত্বে আমি নিজে। বাকি ১৫ জনকে ৫জন করে ৩টি গ্রুপে ভাগ করে তিনটি টাওয়ার ধ্বংস করার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথম গ্রুপের লিডার ছালেহ্ আহমদ, দ্বিতীয় গ্রুপের লিডার আমীন শরীফ ও তৃতীয় গ্রুপের লিডার নায়েক আবুল হাশেম। গ্রুপ লিডারদের দায়িত্ব, অন্য ৪ জনের কাজ অর্থাৎ টাওয়ারের ৪ খুঁটিতে নিয়মমত বিস্ফোরক সংযুক্ত করেছে কিনা তার তদারকি করা এবং সময়মত কাজ শেষ করে আলোর সংকেত পাওয়া মাত্র ফিউজে আগুন দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে আসা। গ্রুপের অন্য ৪ জনের দায়িত্ব হলো প্রত্যেকে আলাদাভাবে টাওয়ারের চার কোণের ৪টি খুঁটির গোড়ায় পানির খুঁটির চারদিকে পেঁচিয়ে তার ভিতর ডেটনেটর ও ফিউজের তার ঢুকিয়ে দিয়ে রশিও কাপড়ের সাহায্যে শক্ত করে খুঁটির সাথে বেঁধে মাটি দিয়ে ভালো করে চাপা দেয়া। টিমের সকল সদস্যকে অপারেশন সংক্রান্ত যার যার করণীয় মাটির মডেল তৈরি করে আগেই ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। যাওয়ার সময় সকলে গ্রুপ ভিত্তিক টার্গেট এলাকায় যাবে এবং কাজীর দিঘির পাড়ে একত্রিত হবে। অপারেশন শেষে একই স্থানে ফেরত এসে গ্রুপ ভিত্তিক ৩ জন ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে রাতের আঁধারে সেল্টারে ফিরে যাবে। ডেটোনেটরের সাথে ৩ মিনিটের ফিউজ অর্থাৎ বারুদ ভর্তি তার যার মুখে আগুন দিলে বারুদ জ্বলতে জ্বলতে ডেটোনেটরকে তিন মিনিট পর হিট করবে এবং সাথে সাথে ডেটোনেটর ব্লাস্ট হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবে। গেরিলারা যাতে ঐ ৩ মিনিটের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বে নির্দিষ্ট স্থান দিঘির পাড়ে চলে আসতে পারে। গ্রুপ লিডারেরা যাতে একই সময় ফিউজে আগুন দিতে পারে তার জন্য আলোর সংকেতের ব্যবস্থা হয় এবং ডিমোনেস্ট্রশনও দেওয়া হয়। আমাদের একত্রিত হওয়ার স্থান ছিল কাজীর দিাঘর পাড়। দিঘির পাড়ের একমাত্র গাছের উঁচু ডালে সাদা কেরোসিন টিনের ১টি কাটা অংশ বাঁধা হলো। ঐ টিনে গাছের নিচ হতে টর্চের মুখে মাঝখানে ছোট ছিদ্র ওয়ালা কালো কাগজ বেঁধে আলো দিলে ঐ সরু আলো টিনের উপর পড়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং অনেক দূর হতে ঐ আলো দেখা যাবে। প্রতিটি দল বা গ্রুপ নির্ধারিত আধ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে শেষ করে সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে দলপতিকে সময় মিলিয়ে হাত ঘড়িও দেয়া হয়েছে। যদি কোনো কারণে আলোর সংকেত মিস হয় তাহলে যেন নির্ধারিত সময়ে ফিউজে আগুন দিয়ে দিঘির পাড়ে ফিরে আসতে পারে। রাত ১২টা ১৫ মিনিটে সকলে যার যার টার্গেট টাওয়ারের উদ্দেশ্য দিঘির পাড় হতে রওয়ানা দিয়ে গেল। আমি প্ল্যান অনুযায়ী গাছের নিচে বসে থাকি সময়মত আলোর সংকেত দেয়ার জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে রাত ১টায় টিনের উপর টর্চের আলোর মাধ্যমে সংকেত দিয়ে সকল সহযোদ্ধার প্রত্যাগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ছালেহ্ আহমদ তার দল নিয়ে দিঘির পাড়ে ফিরে এসেছে। অন্যরাও নির্দিষ্ট স্থানের কাছাকাছি এসে গেছে। এমন সময় দেখা গেল নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০ সেকেন্ড আগে ১টি টার্গেট টাওয়ার প্রচ- শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে আকাশের দিকে উড়ে যায়। অপর ২টি গ্রুপের সদস্যারা তখনও আরভিতে (একত্রিত হওয়ার স্থানে) এসে পৌঁছায়নি। বিলের পানির মধ্যে কয়েক জনের লাফালাফিও লক্ষ্য করা গেল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অপর দু’টি টাওয়ারও একসাথে বিকট আওয়াজ করে উড়ে যায়। সকলে কাঁদা পানিতে ভিজে একাকার হয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় আরভিতে ফিরে কে আগে ফিউজে আগুন দিয়েছে তার খোঁজ নিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাদের কয়েকজন কাঁদতে কাঁদতে জানায় বিদ্যুতায়িত পানি তাদেরকে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। তারা সকলে মারা যেতে পারত। আল্লাহ তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। জানা গেল ছালেহ্ আহমদ নির্দিষ্ট সময়ের ৩০ সেকেন্ড পূর্বে ফিউজে আগুন দিয়েছে বলেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে তার ভুল স্বীকার করে অসাবধানতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে সকলে শান্ত হয়। বিস্ফোরণের গগনবিদারী শব্দে পার্শ্ববর্তী চন্দ্রঘোনা পেপার মিল ও রাঙ্গুনিয়া কলেজে অবস্থিত পাক আর্মি ক্যাম্প হতে বিস্ফোরণ স্থলের দিকে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ শুরু করে। আমরা দ্রুততার সাথে যার যার নির্দিষ্ট ক্যাম্পে অর্থাৎ হোছনাবাদের গজালিয়া এলাকার খামার বাড়ির সেল্টারের উদ্দেশ্যে ২/৩ জনের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে চলে যাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট