চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মুক্তিযোদ্ধা শ্যামল কান্তি দাশ

সন্দ্বীপকে শত্রুমুক্ত করে থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি

নরোত্তম বনিক হ সন্দ্বীপ

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভোরে সন্দ্বীপ থানার তিন পাশে আমরা অবস্থান নেওয়া শুরু করি। ভোরের আলোর সাথে সাথে কৌশলে একজন মুক্তিযোদ্ধা থানার ভিতর ঢুকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ওসিকে অস্ত্র ঠেকিয়ে আত্মসমর্পণ করায়। সিগন্যাল পেয়ে আমরা থানার পুলিশ ও পাহারাদারদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য করি। এভাবে কৌশলে আমরা বিএলএফ ও ফ্রণ্ট ফাইটার (এফ.এফ) সৈন্যরা সন্দ্বীপকে শত্রুমুক্ত করে থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন মুক্তিযোদ্ধা শ্যামল কান্তি দাশ।

সন্দ্বীপের কাটগড়ের নকুলেশ্বর ডাক্তারের ৮ ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় শ্যামল কান্তি দাশ। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল স্বাধীনচেতা ভাব। পাকিস্তান সরকারের অন্যায় ও শোষণ অন্যান্য বাঙালির মতো তার হৃদয়েও ক্ষোভের জন্ম দেয়। যার ফলে ১৯৭১ সালে ২৭ বছরের টগবগে যুবক শ্যামল বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাক আমির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দিতে পূর্বকোণকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ২৭ বছরের যুবক ছিলাম। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী সন্দ্বীপ আসে। তারা থানা আওয়ামী লীগের অফিস পুড়িয়ে দেয়। থানা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল করিম মোক্তারকে গুলি করে হত্যাও করে। এ ঘটনার পর আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত হতে থাকি। মে মাসে রফিকুল ইসলাম কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডার মাহবুবুল আলম (সারিকাইত) তার ছোট ভাই নাজমুল হোসেন বাবুল, আমি নিজে ও আলী হায়দার চৌধুরী, মশিউল আলম জগলু, মৃণাল কান্তি নন্দী (বাটাজোড়া),এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান, ফখরুল ইসলাম রৌশন (সারিকাইত), বোরহান উদ্দিন (কাটগড়), মফিজুর রহমান (মুছাপুর), কামাল উদ্দিন (সন্তোষপুর), সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের আবদুর রবসহ ১৩ জন রফিকুল ইসলাম কমান্ডারের সাথে ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই। ভারতের আসামের লোয়ার হাবলং ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ নিই। অস্ত্র চালানো ও যুদ্ধের কৌশল প্রশিক্ষণ শেষে আমরা আগরতলায় একত্রিত হই। সেখানে একটি ক্যাম্পে রফিকুল ইসলামকে টিম লিডার ও মাহবুবকে ডেপুটি টিম লিডার করে একটি টিম গঠন করে। শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহাম্মদ আমাদের অস্ত্র দিয়ে সন্দ্বীপে পাঠান। আমরা বিএলএফ এর হয়ে যুদ্ধ করতে সন্দ্বীপ আসি। তখন সারাদেশে যুদ্ধ ভয়াবহ অবস্থায় রূপ নেওয়ায় সন্দ্বীপ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য পাঠানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই আমরা সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি। আমাদের পক্ষে মোটামুটি মুক্তিযোদ্ধা যোগাড় হওয়ার পর আমরা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করি।

আমরা দুই বার সন্দ্বীপ থানা আক্রমণ করি। আসাম থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ১১ জনের সঙ্গে বিএলএফ, এফএফ সদস্যরা একত্রিত হই । এসময় অন্য প্লাটুন এবং স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নেওয়া সদস্যসহ প্রায় ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিয়ে প্রথম দফায় থানা আক্রমণ করি। থানা আক্রমণের দিন আমাদের পাঁচটি টিম কাজ করেছিল। একটি টিম এতিমখানায়, একটি ডাকবাংলোয়, একটি কার্গিল হাইস্কুল, একটি মনমোহন মোক্তারের পুকুর পাড়ে ও আরেকটি টিম ছিল টিএন্ডটিতে। পুলিশের সঙ্গে এদিন থানায় সহযোগী হিসেবে ছিল রাজাকার বাহিনী। থানা আক্রমণের সময় রাতে প্রায় ৪ ঘণ্টা গোলাগুলি হয়। গোলাগুলিতে শাহজাহান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয় এবং গৌরাঙ্গ খলিফার দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। সেই রাতের আক্রমণে আমরা থানা দখল করতে না পারলেও পুলিশ, মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকারদের শতাধিক অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিলাম।

থানা আক্রমণের পর সকালে আমরা দক্ষিণ সন্দ্বীপের শিবেরহাটের মাঠের পাশে একত্রিত হয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পানি খাওয়াতে আসা শিবুব্রত রায় নামে একজন ছেলে মুক্তিযোদ্ধার মিস ফায়ারে শহীদ হন। এরপর আমারা বিভিন্ন রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে তাদের আত্মসমর্পণ করাই। এরপর ৩ ডিসেম্বর থানায় দ্বিতীয় দফায় কৌশলে আক্রমণ করে শত্রুদের আত্মসমর্পণ করানোর মধ্যদিয়ে সন্দ্বীপ শত্রু মুক্ত হয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট