চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রেলের ‘নয়ছয়’ দেখবে কে

সেবা নেই অথচ এটেনডেন্টের জন্য গুনছে লাখ লাখ টাকা

নাজিম মুহাম্মদ

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৩৩ পূর্বাহ্ণ

যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে প্রতিটি ট্রেনে জন্য নিয়োগকৃত এটেনডেন্টের পেছনে লাখ লাখ টাকা গুনছে রেল। চলছে রেলের সেবা সপ্তাহ। কিন্তু এটেনডেন্টরা যাত্রীদের সেবায় আগ্রহী নয়। রীতিমতো যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহারও করছেন তারা। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলরত আটজন এটেনডেন্টের পেছনে ছয়মাসে রেলকে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে নয়লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে কাগজে যতজন এটেনডেন্টের কথা বলা হয় বাস্তবে ততজন উপস্থিতও থাকেন না।

যাত্রীসেবায় এটেনডেন্টদের আন্তরিকতা কতটুকু তা সরেজমিন দেখতে গতকাল রবিবার চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায় ভিন্নচিত্র। সকাল ৮টা ১৫মিনিটে প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায় ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেস। এ সময় ‘গ’নম্বর কোচে (বগি) প্রথম শ্রেণির কেবিনে পরিবার নিয়ে উঠেন একজন যাত্রী। কেবিনের আসন, মেঝে, জানালার গ্লাস ধূলা বালিতে ময়লা হয়ে থাকায় উক্ত যাত্রী এটেনডেন্টকে ডেকে তা পরিস্কার করার অনুরোধ করেন। ওই বগির দায়িত্বে ছিলেন দুলাল নামের একজন এটেনডেন্ট। ধুলা-বালি পরিস্কারের কথা শুনে যাত্রীর সাথে অনেকটা রাগান্বিত হয়ে দুলাল প্রথমে বলেন, তিনি ওই বগির দায়িত্বে নন। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা রেলের টিটি ও অন্যনা এটেনডেন্টদের সামনে পরক্ষনে বলেন, ট্রেনের আসনের ধুলা-বালি পরিস্কার করা এটেনডেন্টের কাজ নয়। সুইপার তা পরিস্কার করবেন। এই কথা বলেই বীরদর্পে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন দুলাল। যাত্রাপথে টয়লেট পরিষ্কার, টয়লেট্রিজ সামগ্রী সরবরাহসহ নানা সেবা করার কথা থাকলেও তার কোন সুবিধা পায়নি চট্টলা এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। পরবর্তীতে ট্রেনটির বেশ কয়েকটি বগি ঘুরে দেখাযায়, প্রতিটি বগির সিট ধুলাবালিতে ভরা। ট্রেনের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেঁড়া কাগজের টুকরোসহ ছোটখাটো নানা আবর্জনা। একই সময় প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেস ও সিলেটগামী উদয়নের এটেনডেন্টদের সেবার চিত্রও দেখা গেছে একই রকম।

যাত্রীদের বসার আসনে ধুলা বালি পরিস্কার করা এটেনডেন্টের কাজ নয়- দুলাল এমনটি দাবি করলেও তার বক্তব্য সঠিক নয়। পূর্বাঞ্চল রেলের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এটেনডেন্ট দুলালের মিথ্যা বলা ঠিক হয়নি। উক্ত কর্মকর্তা বলেন, যাত্রীসেবা দিতে এটেনডেন্টদের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে রেল। প্রতিটি বগিতে একজন করে এটেনডেন্ট নিয়োগ দেয় রেল। ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা আগে নির্ধারিত প্লাটফর্মে উপস্থিত থাকবেন প্রত্যেক এটেনডেন্ট । প্রত্যেকে নির্ধারিত কোচের যাবতীয় সরঞ্জাম, ফিটিংস বুঝে নিয়ে সংশ্লিষ্ট রেজিস্টারে স্বাক্ষর করবেন। এটেনডেন্টেরা নিজ নিজ কোচের সকল দরজা বন্ধ করে শুধুমাত্র একটি দরজা খোলা রেখে টিকেটধারী বৈধ যাত্রীকে নিজস্ব আসনে বসতে সহযোগিতা করবেন।

রেলের প্রচলিত নিয়ম মেনে যাত্রীদের সুবিধার জন্য দরজা জানালা খোলা বা বন্ধ করার কাজে সহযোগিতা করবেন। শুধু তাই নয়-ট্রেনের আসন, জানালার সাইড, যাত্রীদের ব্যবহারের সব ধরনের স্থাপনা পরিস্কার করে দেবেন। যাত্রীদের টয়লেট ব্যবহার, নামাজ আদায়, খাবার গ্রহণ, পত্রিকা সরবরাহ, পানি পানসহ সব বিষয়ে যাত্রীদের সহযোগিতা করবেন। ট্রেন ছাড়ার আগে চলন্ত ট্রেনের প্রতিটি বগিতে মশা/পোকামাকড় মুক্ত রাখতে এরোসল ও এয়ারফ্রেশনার ব্যবহার করবেন। সন্ধ্যায় মুঠোফোনে চট্টলা এক্সপ্রেসের ‘গ’বগির উক্ত যাত্রীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে হলে জানান, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাবার প্রায় সাতঘণ্টার যাত্রাপথে কোন এটেনডেন্টের দেখা তারা পায়নি।

যাত্রীসেবায় এটেনডেন্টদের অবহেলা থাকলেও ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনে আটজন এটেনডেন্টের পেছনে আগামী ছয়মাসে নয়লাখ টাকা খরচ গুনবে রেল। এরবাইরে যাত্রীদের কাছে টয়লেট্টিজ সামগ্রী, রেলের তালিকা অনুযায়ী ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীর খরচ তো আছেই।

অনুসন্ধানে জানাযায়, বিজয় এক্সপ্রেসে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত চার বছর কাজ করেছে ১৮জন। এরমধ্যে ১৪বগিতে ১৪জন অ্যাটেনডেন্ট, দুইজন সুইপার, একজন টেলিফোন অপারেটর, একজন ম্যানেজার। যাত্রীসেবায় নিয়োজিত ১৮ জন ব্যক্তির জন্য প্রতিমাসে প্রায় দুইলাখ টাকা হিসাবে ছয়মাসে তাদের পেছনে ১২ লাখ টাকা গুনতে হতো রেলকে। এ ১২ লাখ টাকার মধ্যে টয়লেট্টিজ সামগ্রী, ফাস্টএইড,রেলের তালিকাভুক্ত ওষুধ সরবরাহের খরচও মেটাতে হতো। গত ১ নভেম্বর থেকে ছয়মাসের জন্য ১৮ জনের স্থলে আরো ৮জন বাড়িয়ে ২৬ জন এটেনডেন্ট নিয়োগ দিয়েছে রেল। অতিরিক্ত ৮জন এটেনডেন্টের পেছনে ছয়মাসে রেলকে আরো নয়লাখ টাকা বেশী খরচ গুনতে হবে। এর বাইরে যাত্রীদের দেয়ার নামে টয়লেট্টিজ সামগ্রী, রেলের তালিকাভুক্ত ওষুধ সামগ্রীর বাড়তি খরচতো রয়েছেই। রেলের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ নতুন করে ২৬ জন অদক্ষ এটেনডেন্ট নিয়োগ দিয়েছেন গত ১৭ অক্টোবর।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান যন্ত্রপ্রকৌশলী মিজানুর রহমান, আগের ১৮ জন ঠিকাদারের মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ে নেয়া হয়েছিলো। তাদের মজুরী খরচ কম ছিলো। তাদের কোন ধরনের ট্রেনিং ছিলো না। ট্রেনে তারা নানা অনিয়ম করতো। ট্রেনিংপ্রাপ্ত না হবার কারণে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ভালভাবে বুঝতো না। এ কারণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এভাবেই নেয়া হয়েছে। অদক্ষ এসব শ্রমিকদের ট্রেনিং দেয়া হবে বলেও দাবি করেন রেল কর্মকর্তা মিজানুর রহমান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট