চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

আবাসিক হলে বাড়ছে অস্ত্র

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় হ ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপগুলো সংঘর্ষে জড়ায় হ অস্ত্রের নেপথ্যে এজেন্ডা ও স্বার্থ জড়িত : শিক্ষক সমিতির সভাপতি

চবি সংবাদদাতা

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৩৩ পূর্বাহ্ণ

নিজেদের মধ্যেকার অন্তঃকোন্দল, আধিপত্য আর শক্তিমত্তাকে জিইয়ে রাখতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আবাসিক হলগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নানান ধরনের দেশি-বিদেশি অস্ত্রের সম্ভার। ‘পান থেকে চুন খসলেই’ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপগুলো। এসব সংঘর্ষে প্রতিপক্ষকে আক্রমণের জন্য রামদা, কিরিচ, কিংবা চাকু-চাপাতি দিয়ে অস্ত্রের মহড়া দেয় বিক্ষুদ্ধ নেতাকর্মীরা। আবার কখনও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ ঘটানো হয় ককটেলের।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামাল দিতে নামমাত্র তল্লাশি চালিয়ে লাঠিসোঁটা ও হাতেগোনা কিছু ধারালো অস্ত্র উদ্ধারে সীমাবদ্ধ থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। এরপরেও থেমে নেই অস্ত্রের ঝনঝনানি। গ্রেপ্তার কিংবা আটক থেকে অধরাই থেকে যায় অস্ত্রধারী। ফলে অজানাই থেকে যাচ্ছে অস্ত্র মজুদকারিদের নাম। গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ নজরদারির মধ্যেও ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মজুদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে।
বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, ‘অতীতেও বিভিন্ন সময়ে এ বিশ^বিদ্যালয়ে অস্ত্রের রাজনীতি দেখেছি। অস্ত্রের ব্যবহার কখনো ছাত্র রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। তখন তা জবর দখলের রাজনীতি হয়। যেখানে এজেন্ডা আর স্বার্থ জড়িত থাকে’।

তিনি আরো বলেন, ‘অস্ত্র রাখতে পারাটা যে প্রতিটা বিশ^বিদ্যালয়ে লাগামহীন ক্ষমতাচর্চা হচ্ছে তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এগুলো রাখলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এটা তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এস্টাবলিশ করতে পারেনি। ফলে এগুলো হওয়াটাই স্বাভাবিক। কর্তৃপক্ষকে এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে’।

এদিকে হলে অস্ত্র মজুদের পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করছেন আইন শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী। এক্ষেত্রে তারা পাহাড় এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনকে নিরাপদ পথ হিসবে বেছে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা পূর্বকোণকে বলেন, ‘গত দুই বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রায় ছয়বারের মতো অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে রামদা, পাইপগান, এলজি, লোহার রডসহ দেশি অস্ত্র উদ্ধার করেছি’।
ক্যাম্পাসে কিভাবে অস্ত্র আসে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্ভবত পাহাড়ের পথ দিয়েই অস্ত্রগুলো মজুদ করা হয়। আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন নেতাদের মাধ্যমে এসব অস্ত্র ক্যাম্পাসে প্রবেশ করছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা আছে। পুলিশ এসব অস্ত্রধারীরদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে’।

২ বছরে দুই শতাধিক রামদা উদ্ধার :
বিভিন্ন সময় সংঘর্ষের পরে অভিযান চালিয়ে গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে দুই শতাধিক রামদা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারপরেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হলগুলোতে ঢুকছে নানান ধরনের অস্ত্র। কোনো গ্রুপ-উপগ্রুপ হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লেও চোখে পড়ছে এসব অস্ত্রের বিপুল সমাহার।

সর্বশেষ গত ২৯ নভেম্বর রাত থেকে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিন দিনে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় বগি ভিত্তিক গ্রুপ সিএফসি ও ভিএক্সের নেতাকর্মীরা। এ সময় উভয় পক্ষকে ক্যাস্পাসে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যায়। পরিস্থিতি সামাল দিকে পরেরদিন গত ৩০ নভেম্বর চারটি আবাসিক হলে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় ১৫-২০ টা রামদা, লোহার পাইপ ও চার বস্তা পাথর উদ্ধার করা হয়।

এর আগে গত পহেলা এপ্রিল ও ২৫ ফেব্রুয়ারি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তুচ্ছ ঘটনায় দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দেয়। প্রতিটি ঘটনার পরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হলে তল্লাশি চালিয়ে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে। পুুলিশ জানায়, অভিযানে উদ্ধার হওয়া বেশিরভাগ অস্ত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ায় অপরাধীদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে একটি দুটি নয় বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নয়টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এগুলো বিভক্ত রয়েছে দুটি ধারায়। একপক্ষ শিক্ষাউপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। অপরপক্ষ সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী। এসব গ্রুপ নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে হলগুলোতে প্রতিনিয়ত ঢুকছে দেশি-বিদেশি নানা অস্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশি- বিদেশি রিভলবার, রামদা, জিআই পাইপ, হকিস্টিক অন্যতম। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গত দুই বছরে আহত হয়েছেন শতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী। এসব ঘটনায় অনেকের জীবন বিপন্ন হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় অস্ত্রধারীরা। সর্বশেষ গত ১ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন সুমন ও ছাত্রলীগ কর্মী আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান রাফিকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীরা। দুইজনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে গত ১ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগ কর্মী কনক সাহা জয়কে চাপাতি, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের কর্মীরা। পিঠে রামদার কোপ ভেতরে গিয়েছে তিন ইঞ্চি। তাতে সেলাই লেগেছে সাতটি। কিডনির কাছে গিয়ে ঠেকেছে এই রামদা। কোমরে, পায়ে, উরুসহ শরীরজুড়ে অসংখ্য ছুরিকাঘাত। চাপাতির কোপে বিচ্ছিন্ন প্রায় বাম পায়ের গোড়ালি। কিছুদিন আগে কনক ক্যাম্পাসে ফিরলেও চলাফেরা স্বাভাবিক হয়নি।

এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, ‘চবি ছাত্রলীগ কোনো ধরনের সংঘর্ষ ও অস্ত্রের রাজনীতির পক্ষে না। আমরা বারবার পুলিশ ও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি, সিসি ক্যামেরা দেখে যারা ছাত্রলীগ নাম দিয়ে অস্ত্রের রাজনীতি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নির্বিকার থাকতে দেখা যায়’।

তিনি বলেন, ‘সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়েও শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসলে এখানে শৃৃঙ্খলা ফিরে আসবে’।

এদিকে হলে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাকে বেদনায়ক বলে মনে করেন সোহরায়ার্দী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ বশির আহাম্মদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মনিরুল হাসান পূর্বকোণকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে। এখন তা প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। তবে অস্ত্রধারী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট