চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

উত্তর জেলা আ. লীগের সম্মেলনে কাদের

ত্যাগীরা নেতা হবেন, মাস্তানরা নয়

হ দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও চেয়ার ছোড়াছুড়ি হ সুবিধাবাদীরা এলে আওয়ামী লীগ টিকবে না হ কালুরঘাটে রেল ও সড়ক সেতু হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মাস্তানি করে নেতা হওয়া যায় না। শ্লোগান দিয়ে নেতা বানানো যাবে না। বিলবোর্ডে সুন্দর সুন্দর ছবি দিয়ে নেতা হওয়া যায় না। ঝকঝকে পোস্টারের ছবি কাউকে নেতা বানাবে না। নেতা হবে দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুযায়ী। নেতা হবেন ত্যাগীরা, যারা দলের দুঃসময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুখে-দুঃখে যারা দলের সঙ্গে ছিলেন, তারাই হবেন নেতা। গতকাল শনিবার উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।

ওবায়দুল কাদের মঞ্চে বক্তব্য শুরু করলে নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতে শুরু করেন। তাদের উদ্দেশে কাদের বলেন, তোমাদের সেøাগানে কি নেতা বানাব? ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যাদের বিলবোর্ড-ব্যানার বেশি ছিল, তারা কেউই নেতা হননি। গত কয়েকদিনে অনেকগুলো সম্মেলন করেছি। নেতা নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে।
সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরুর আগেই মিরসরাইয়ের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি এবং চেয়ার ছোড়াছুড়ি হয়। তবে তখনো জ্যেষ্ঠ নেতারা সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হননি। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর সভাপতিত্বে সম্মেলন উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমএ সালামের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, প্রচার সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী ও সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম, আওযামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপ-মন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উপ-দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া।

ওবায়দুল কাদের বলেন- পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, খারাপ লোককে দল ভারী করার জন্য আওয়ামী লীগে আনবেন না। বুয়েটের আবরার হত্যাকারীর মতো কর্মী আমাদের দরকার নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কথায় কথায় মারামারি করে, এমন লোক আমাদের দরকার নেই। রাজশাহীতে অধ্যক্ষকে পানিতে ফেলে দেয়, এমন কর্মী আমাদের দরকার নেই। চট্টগ্রামের মাটি শেখ হাসিনার ঘাঁটি। এ ঘাঁটিতে যে ফাটল ধরেছে, তা ক্লোজ করে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই, সুবিধাবাদী চাই না। মৌসুমী ও অতিথি পাখিদের স্থান আওয়ামী লীগে নেই। দল ভারী করার জন্য যে পকেট কমিটি করবে, তাদের প্রয়োজন নেই। নেতৃত্বে সুবিধাবাদীরা আসলে সে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে পারবে না। দুঃসময়ে পাঁচ হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বালিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন নেতা উৎপাদনের কারখানা। কর্মী উৎপাদনের কারখানা কমে গেছে। ব্যানার-পোস্টার লাগাতে এখন আর কর্মী পাই না। ভাড়া করা টোকাই দিয়ে লাগাতে হয়। এখন সবাই নেতা হয়ে গেছে, কর্মী কেউ নয়। তবে, নেতা হতে গেলে আগে কর্মী হতে হবে। যারা নেতা হতে চান সৎ জীবনযাপন করবেন। কত টাকা দরকার জীবনের জন্য ! চাঁদাবাজ আওয়ামী লীগের নেতা হতে পারে না। টেন্ডারবাজ, জমি দখলকারী আর সন্ত্রাসীদের ‘না’ বলুন। ক্ষমতা আজ আছে, কাল নেই। জনগণের মাঝেই আমাদের থাকতে হবে। আমাদের ক্ষমতার উৎস জনগণ। আর বিএনপির ক্ষমতা বন্দুকের নল।
ওবায়দুল কাদের বলেন- রাজনীতি বীরের জন্য, কাপুরুষরা কখনও সফল হতে পারে না। আজ নেতা হতে না পারলে কাল হবেন। দল ত্যাগী ও নিবেদিতদের অবশ্যই মূল্যায়ন করবে। দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ পরিচ্ছন্ন ইমেজের কর্মীরা এখন নেতৃত্বে আসবে। শুদ্ধি অভিযান সফল করতে হবে। কে কখন জালে আটকাবে জানি না। আজ বাদল নেই, তাকে স্মরণ করেই বলছি, কালুরঘাটে রেল ও সড়ক সেতু হবে।

উদ্বোধনী বক্তব্যে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি বলেন, আমি আজকে আবেগের মধ্যে আছি। হয়তো এটি আমার জীবনের শেষ সম্মেলন। কারণ আমার সঙ্গে এই মঞ্চে যারা থাকতো- সেই আখতারুজ্জামান বাবু, আতাউর রহমান খান কায়সার, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধরী- তারা কেউ নেই। বাবুকে হারিয়েছি, কায়সারকে হারিয়েছি, মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়েছি, ওহাব ভাইকে হারিয়েছি, আজিজ ভাইকে হারিয়েছি, মান্নান ভাইকে হারিয়েছি, জহুর আহমেদকে হারিয়েছি, এমএ হান্নানকে হারিয়েছি। আগামী দিনে আমিও এ ধরনের সম্মেলন পাবো কিনা জানি না। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য রয়েছে। ১৯৮০ সালে যখন স্বৈরাচারী জিয়ার বিরুদ্ধে আমরা শান্তিপূর্ণ মিছিল করেছিলাম, তখন আমাদের মিছিলের ওপর আক্রমণ হয়। নিউ মার্কেট মোড়ে আমার পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। ১৯৯২ সালে যখন ছাত্রলীগের কনফারেন্সে যাচ্ছিলাম, তখন শিবির আমাদের ওপর আক্রমণ করে। আমাকে লাঞ্ছিত করে। এমন সব সংগ্রামী ইতিহাসের মধ্য দিয়ে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ আজকের এই অবস্থানে এসেছে। একটি সুসংগঠিত ইউনিট হিসেবে শেখ হাসিনার একেকজন অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের নেত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যারা পদ পেয়ে পদবীকে ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করবে এমন লোক আমরা চাই না।

এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন, আওয়ামী লীগ আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার স্পেশাল কোর্টে নয়, সাধারণ কোর্টে করা হয়েছে। ২১ বছর পর আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পেয়েছি। খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি। দশ বছর পার হওয়ার পর বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় থাকবে না। তার ছেলে তারেক জিয়া সিঙ্গাপুরের কোর্টে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। তার আর বাংলাদেশে এসে রাজনীতি করা সম্ভব হবে না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি বিএনপির শ্রদ্ধা নেই। বিএনপির আইনজীবীরা আদালতের এজলাসে যে তা-ব চালিয়েছে তা নজিরবিহীন। পৃথিবীর কোনো দেশে প্রধান বিচারপতির এজলাসে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা মানুষ দেখেনি। বেগম খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি ছিল। আদালতে মেডিকেল রিপোর্ট না আসার কারণে এক সপ্তাহ সময় চেয়ে আবেদন করেছিলেন এটর্নি জেলারেল। আদালত মাত্র এক সপ্তাহ সময় দিয়েছেন- কিন্তু সেটা তারা সহ্য করতে পারেনি। অথচ বেগম জিয়ার দুর্নীতির মামলা যখন পরিচালিত হয়েছে তখন সেই মামলায় ১০৮ বারের বেশি সময় নেয়া হয়েছিলো। বিএনপি আইনের শাসনে বিশ্বাসী নয়।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন- খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে বিএনপি যা করেছে, জামিন হলে তারা কি ঘটাবেন তা সহজে অনুমেয়। বেগম জিয়ার জামিন চাইতে গিয়ে বিএনপির আইনজীবীরা ছয় বিচারপতির বেঞ্চে যেভাবে হাঙ্গামা করেছে, দেশের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। জামিন শুনানি এক সপ্তাহ পেছানোতে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। যা চরম আদালত অবমাননা এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞা। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে তারা। অবশ্য এর আগে তারা প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথিও মেরেছিলেন। দেশের বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখা এবং প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার বিপরীতে যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আদালত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

শিক্ষা উপ-মন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তারেক জিয়াকে কুলাঙ্গার আখ্যা দিয়ে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে দেশের মানুষ কুলাঙ্গার তারেক রহমানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। বিএনপির কা-ারী দুর্নীতির বরপুত্র তারেক রহমানকে দেশের মানুষ চায় না। বিএনপির কাজ এখন শুধু প্রেস কনফারেন্স করা। আর আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা।

মঞ্চে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, সাংসদ দিদারুল আলম, মাহফুজুর রহমান মিতা, খাদিজাতুল আনোয়ার সনিসহ জেলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকগণ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট