চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের ১২ ডিসেম্বর বাঁশখালী হানাদারমুক্ত হয়

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঁশখালী

৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৬৯ সালের শেষ দিকে সৈনিক হিসেবে আমি সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। কোয়ান্টাম ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষে রাওয়ালপিন্ডিতে আমার পোস্টিং হয়। ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসার পথে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সমাবেশে যোগদান করি। জাতির পিতার সেদিনের ঐতিহাসিক ভাষণের পর পাক হানাদার বাহিনী এদেশের রাজাকার আলবদরদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। ১৯৭১ সালে ঢাকার সেনা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ১৫ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী গ্রামের বাড়ি পুকুরিয়ায় চলে আসি। ২৬ মার্চ স্থানীয় সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম কোর্টবিল্ডিং, নিউমার্কেট, নন্দনকানন এলাকায় পাকবাহিনীর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। ঐদিন ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। ২৯ মার্চ রাতে কর্ণফুলী নদী হয়ে বাঁশখালীতে ফিরে আসি। ৬ এপ্রিল পুকুরিয়ায় বোনের বাড়িতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইয়ের সাথে দেখা করি। সেখান থেকে তিনি, আবু ছালেক, সুলতান আহমদ কুসুমপুরী ও ইদ্রিস বি.কমসহ ১০৪ জন ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য পাড়ি দেই। তিনি আরো বলেন, আসাম রাজ্যের ঠেলার খাল হয়ে কচুছড়ি অবস্থান করি। এরপর পানছড়ি ক্যাম্পে অবস্থান নিই। আমি সেনাবাহিনীর সৈন্য হিসেবে প্রশিক্ষণ দ্রুত আওতায় নিয়ে আসি। পরবর্তীতে আনুমানিক ২০/২৫ এপ্রিল দেমাগ্রিতে যাই। সেখানে ১৫ দিন অবস্থান করে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর প্রশিক্ষক টিএম আলীসহ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে আসি। আমাদের দলে ছিল ৩০ জন। তার মধ্যে পুলিশ, আর্মি, বিডিআর সদস্য ও ৪ জন ছাত্র ছিল। পাহাড়ি পথ বেয়ে রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া রোয়াজারহাট এসে ফরেস্ট ক্যাম্পে অবস্থান নেই। পরবর্তীতে ৪ জুন রাতে সাতকানিয়ার রাজঘাটা মাদ্রাসায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ঘেরাও করি। সেখানে রাত ১২টার দিকে যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের গুলিতে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। সেখান থেকে ৫ জুন মদুনাঘাট ফিরে গিয়ে বিদ্যুৎ ও যাতায়াত ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করি। ৭ জুন বোয়ালখালী থানা আক্রমণ করি। এ সময় পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ওই থানার পুলিশ সদস্যরা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের আরো জানান, ১৯৭১ সালের ১৯ মে বাঁশখালীতে পাকবাহিনী প্রথম হানা দেয়। ঐদিন ১০ ট্রাক সাজোয়া বহর নিয়ে বাণীগ্রাম থেকে শুরু করে নাপোড়া পর্যন্ত জঘন্যতম বর্বর নির্যাতন, বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ লোকজনদের গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই দিন ৬২ জন নিরীহ লোককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। বাঁশখালীতে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সুলতান উল কবির চৌধুরী গ্রুপ, ছমিউদ্দিন গ্রুপ, মোক্তার আহমদ চৌধুরী গ্রুপ, নুরুল কবির চৌধুরী গ্রুপ। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে বাঁশখালীর দায়িত্বে ছিলেন বিএলএফ কমান্ডার ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী। ঊনার নেতৃত্বে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিবাহিনী একত্রিত হয়ে পাকাবাহিনীকে পরাস্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতো। ১৭ নভেম্বর বাণীগ্রাম ও পুকুরিয়া ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদে রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালানো হয়। এ সময় পাকিস্তানী ও রাজাকার সৈন্যদের গুলিতে রাতেই আমাদের সাথে থাকা সার্জেন্ট মহিউল আলম শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর রাতে ফের অবস্থান নিয়ে ১১ ডিসেম্বর ভোরে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। ওই সময় রাজাকার-আলবদর সদস্যদের লক্ষ্য করে শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। এক পর্যায়ে রাজাকার-আলবদররা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ওই সময় রাজাকার আলবদরদের বাণীগ্রাম ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ১২ ডিসেম্বর বাঁশখালী পাক হানাদারমুক্ত হয়। ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা থানার অস্ত্রাগার দখলে নেয়।

৪ সন্তানের জনক মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের আরো বলেন, শঙ্খের জোয়ারের তোড়ে বসতভিটা হারিয়ে বর্তমানে পাহাড়ের সরকারি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। এখানে বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ রোপণ করে এবং চাষাবাদ করে দিন যাপন করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদেরকে সম্মাননা স্বরূপ ভাতা প্রদান করছেন শেখ হাসিনা। পরিবারের সদস্যদেরকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট