চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সমস্যায় হাবুডুবু, পথহারা খামারিরা সাতকানিয়া

সুকান্ত বিকাশ ধর হ সাতকানিয়া

৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

সাতকানিয়ায় ডেইরি খামারিরা নানামুখী সমস্যার আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছেন। বাণিজ্যিক ও শখের বসে অনেকেই খামার শুরু করলেও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সরকার প্রদত্ত প্রয়োজনমত ওষুধ না পাওয়া, পশু পথ্যের অভাব ও প্রাইভেট দোকানগুলোতে ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় খামারিরা বাধ্য হচ্ছেন এ ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে। তবে এখনও অনেক খামারি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা অপর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ ও লোকবলের অভাবে এসব সমস্যার সৃষ্টি বলে জানিয়েছেন। জানা যায়, সাতকানিয়া উপজেলাটি একটি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সবকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় কম-বেশি ডেইরি খামার রয়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪৪টি ডেইরি খামার রয়েছে এ উপজেলায়। এরমধ্যে বেশির ভাগই দুগ্ধজাত গরুর খামার।

সাতকানিয়া উপজেলাটি বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত হওয়ায় প্রায় অর্ধশত খামার দিয়ে দুধের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এ সামান্য দুধ উপজেলার বাইরে সরবরাহ তো দূরের কথা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে আরো বেশি বেশি ডেইরি খামার স্থাপন প্রয়োজন বলে সচেতনমহল মনে করেন। তবুও দুধের চাহিদা মেটানো ও খামার করে অনেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করলেও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের অসহযোগিতা ও বাজারে ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় খামার স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছেন না অনেক আগ্রহী ও বিত্তশালী। সাতকানিয়ার পুরানগড় ইউনিয়নের শীলঘাটা এলাকার বাসিন্দা বর্তমানে ফেনী জেলা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) ওসি রনজিত কুমার বড়–য়া বলেন, বিগত ৭/৮বছর আগে আমি ও আমার স্ত্রী শেলী বড়–য়ার উদ্যোগে আমাদের গ্রামের বাড়ি শীলঘাটায় কয়েকটি গরু নিয়ে দুগ্ধ খামার শুরু করি। বর্তমানে আমাদের খামারে ২২টির মত দুগ্ধজাত বিভিন্ন প্রজাতির গরু রয়েছে। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গরুর পরিচর্যা

করলেও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পাই না। যদি খামারিদের সরকারিভাবে ওষুধ সরবরাহ, দুধের বাজারজাতকরণের জন্য স্থান নির্ধারণ ও প্রজনন সুবিধা অবারিত করা যায় তাহলে দুধ উৎপাদনে সাতকানিয়ার খামারিরা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি আশা করি।
সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে এসে দুগ্ধজাত খামার গড়ে তুলতে আগ্রহী হলেও বর্তমান খামারিদের অবস্থা দেখে এ ব্যবসায় বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা। খামারিদের বিভিন্ন সরকারি সহায়তা দেয়া হলে পুরাতন খামারিদের সাথে নতুন খামারি যুক্ত হয়ে সাতকানিয়ায় দুগ্ধ বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে বলে খামার সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধারণা করছেন।

সরেজমিন পরিদর্শন ও খামারিদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, খামারিরা দুগ্ধজাত গরুর মধ্যে হল স্ট্রেইন ফ্রিজিশিয়ান, শাহিওয়াল, সিন্ধি ও জার্সিজাতের গরু খামারে পালন করে থাকেন বেশি। এ দুগ্ধজাত গরু খামারিরা লালন-পালন করতে প্রতিনিয়তই মুখোমুখি হচ্ছেন নানা সমস্যায়। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রজনন, গরুর ক্ষুরা রোগ, ম্যাসটাইটিস (ওলান ফুলা রোগ) ও গলা ফুলা রোগ। পাশাপাশি রয়েছে গো-চারণ ভূমির অভাব, বাজারজাতকরণ, বিদ্যুৎ ও ঘাস রোপণে সরকারিভাবে অপর্যাপ্ত সহায়তা। এসব সমস্যা প্রায় সময় দেখা দিলেও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের কাছে ধর্ণা দিয়েও কোন লাভ হয় না। ফলে অনেক খামারি লোকসান গুণে ফিরিয়ে নিচ্ছেন মুখ।
সাতকানিয়া পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের উত্তর রামপুর এলাকার মো. লিটন নামে এ খামারি পূর্বকোণকে বলেন, শখেরবশে ও পরিবারের দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য ৩টি হলস্টেন ফ্রিজিয়ান জাতের গরু ক্রয় করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেছে রোগাক্রান্ত হলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের কাছে ওষুধ আনতে গেলে তারা চাহিদামত ওষুধ দিতে পারেন না। বলা হয়, সরকারি সাপ্লাই নেই। বাইরে থেকে কিনে নিতে হবে। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় চাহিদামত দুধ পাওয়া যাচ্ছে না এখন।

সাতকানিয়া উপজেলা ডেইরি ফার্মার গোলাম ফেরদৌস রুবেল প্রকাশ রুবেল রাজ বলেন, সাতকানিয়ার অনেক খামারে গরু মোটা-তাজাকরণও করা হয়। গরুর বিভিন্ন রোগের মধ্যে দুগ্ধজাত গরু ম্যাসটাইটিস রোগে আক্রান্ত হলে দুটি অথবা একটি ওলান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে যেখানে ২০ লিটার দুধ একটি গরু থেকে আগে পাওয়া যেত, সেখানে প্রায় ৮ লিটারের মত দুধ পাওয়া যায় ভাইরাস আক্রান্ত এই গরু থেকে। যে কারণে গুণতে হয় লোকসান। তিনি বলেন, খামার করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হলেও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে একটি কৃমিনাশক ট্যাবলেটও পাওয়া যায় না। কর্মকর্তারা খামারিদের বলেন, এ ওষুধের কার্যকারিতা নেই। বাইরের দোকান থেকে নেন।
গোলাম ফেরদৌস আরো বলেন, বাজারজাতকরণের জন্য স্থান নির্বাচন, কম সুদে সরকারি ঋণ সুবিধা, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিল না করে চাষি বিল ও গরুর পথ্য ঘাস রোপণে সরকারি পূর্ণাঙ্গ সহায়তা ফেলে সাতকানিয়ায় দুগ্ধ বিপ্লব ঘটিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ে অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

সাতকানিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, উপজেলায় তালিকাভুক্ত ৪৪টি ডেইরি খামার রয়েছে। তালিকার বাইরেও রয়েছে অনেক খামার। বর্তমানে খামারিরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তা সমাধানে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে লোকবল বাড়ানো ও পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ থাকা আবশ্যক। ইতিমধ্যে লাইভ স্টক ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বোর্ড গঠন করা হয়েছে। লোকবল নিয়োগের কাজও শেষ। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে খামারিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কম সুদে ঋণ প্রদান করে এ সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে গেলে খামারিরা আশার আলো দেখার পাশাপাশি নতুন খামারিও যুক্ত হবে এ ব্যবসায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট