চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সঞ্চয়হীন নজরুলের স্ত্রীও কোটিপতি

স্ত্রী ও নজরুলের নামে দুদকের আরও মামলা হ পাঁচ একাউন্টে দশ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য হ দশ বছরে স্ত্রীর নামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ

ইমাম হোসাইন রাজু হ

২২ নভেম্বর, ২০১৯ | ৩:১৬ পূর্বাহ্ণ

জেলা প্রশাসকের এল এ শাখার চেইনম্যান (বর্তমানে ফটিকছড়ি উপজেলায় সংযুক্তি) নজরুল ইসলাম। সরকারি চাকুরি করে প্রাপ্ত বেতনভাতা ছাড়া অন্য কোন আয়ের উৎস নেই এই কর্মচারীর। যার জন্য তার নামে নেই কোন আয়কর নথিও। সরকারি বেতন বাবদ যা পায়, তা পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ে খরচ করেন তিনি। এর বাইরে তার কোন সঞ্চয় নেই। তবে চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে তিনটি দোকান থাকায় ২০০৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারকে কর দিয়ে আসছেন তিনি। যেখানে আয়কর রিটার্নে তিনি ব্যয় বাদে ১৫ লাখ ৫৩ হাজার ১০০টাকা বৈধ আয় করেছেন বলে উল্লেখ করেন। তবে বাস্তব চিত্র তার উল্টো।

শুধুমাত্র এল এ শাখায় কর্মরত থেকে তিনি গড়েছেন প্রায় ১৩ কোটি টাকার অঢেল সম্পদ। এরমধ্যে নগরীর একটি ব্যাংকেই তার ও স্ত্রীর নামে রয়েছে পাঁচটি একাউন্ট। যার মাধ্যমে গত দশ বছরে লেনদেন করেছেন প্রায় দশ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধুমাত্র চলতি বছরেই সবচেয়ে বেশি লেনদেন করেন তিনি। সবগুলো টাকাই ছিল ঘুষ বাণিজ্যের। এলএ শাখার চেইনম্যানের এমন সম্পদের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের অনুসন্ধানে। এসবের মধ্যে নজরুল ও তার স্ত্রীর ব্যাংক একাউন্টে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দশ কোটি টাকা ও তিন কোটি টাকার সম্পদ পেলেও এর বাইরেও তাদের নামে আরও বিপুল সম্পত্তি রয়েছে। তবে দুদকের অনুসন্ধানে যে সকল সম্পদ পাওয়া গেছে, তার বর্তমান মূল্য শতকোটি টাকারও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নগদ অর্থ ও কোটি টাকার চেকসহ সম্প্রতি দুদকে হাতে গ্রেপ্তার হয়ে নজরুল রয়েছেন কারাগারে। এরমধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের (৪৮) বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করে দুদক। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এ এ মামলাটি দায়ের করা হয়। তবে নজরুল ইসলাম কারাগারে থাকলেও স্ত্রী পলাতক রয়েছে।
মামলায় নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী একে অপরের সহযোগিতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সন্দেহজনক লেনদেন করে এবং হস্তান্তর ও রূপান্তর করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। এতে ২০১২ সালের ৪(২) ধারা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা রুজু করা হয় বলেও উল্লেখ করা হয়।

পাঁচ একাউন্টে যত টাকা : নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর নামে থাকা একাউন্টের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, পাঁচটি একাউন্টেই তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) নগরীর মুরাদপুর শাখায় খুলেছেন। যেটির অবস্থান ষোলশহরস্থ চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে। এ পাঁচ একাউন্টের মধ্যে নজরুল ইসলামের নামে দু’টি থাকলেও বাকি তিনটি স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের নামে। এ পাঁচটি একাউন্টে কয়েক বছরে লেনদেন করেছেন ৯ কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭৬ টাকা। এরমধ্যে ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৮ টাকা উত্তোলন করলেও এখন পর্যন্ত স্থিতি রয়েছে ১ কোটি ৩১ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৮ টাকা।

এসব একাউন্টের মধ্যে ২০০৮ সালে নিজ নামে খোলা একটি একাউন্টে চলতি বছর পর্যন্ত জমা করেছেন ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার ২১১ টাকা। উত্তোলন করেছেন ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৯৯ হাজার ১৬৯ টাকা। এখন পর্যন্ত এই একাউন্টে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৩ টাকা স্থিতি রয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে খোলা আরেকটি একাউন্টে জমা করেন ১ কোটি ২৩ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকা। এরমধ্যে ১ কোটি ৯ লাখ ৯৭৩ টাকা উত্তোলন করেন নজরুল। বাকি ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৬৯ টাকা স্থিতি আছে এই একাউন্টে।

অন্যদিকে স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের নামে থাকা তিন একাউন্টের মধ্যে ২০১৫ সালে খোলা একটি একাউন্টে চলতি বছর পর্যন্ত জমা হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৬ টাকা। এরমধ্যে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৭ টাকা উত্তোলন করলেও এখন পর্যন্ত ওই একাউন্টে স্থিতি রয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৮২৮ টাকা। ২০১৭ সালে খোলা আরেকটি একাউন্টে জমা হয় ১ কোটি ১৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। মাত্র দুই বছরের মধ্যে এ একাউন্ট থেকে ৬০ লাখ ৯৪ হাজার ৬৩৩ টাকা উত্তোলন করলেও এখন পর্যন্ত তাতে স্থিতি রয়েছে ৫৪ লাখ ৪৯ হাজার ৩৬৬ টাকা। এছাড়া ২০১৮ সালে খোলা আরেকটি একাউন্টে জমা হয় ১ কোটি ২৯ লাখ ৬২ হাজার ২৮৬ টাকা। এরমধ্যে তিনি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭৯৫ টাকা উত্তোলন করলেও বাকি ৫৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪৯১ টাকা এখন পর্যন্ত স্থিতি রয়েছে।

চেইনম্যানে স্ত্রীর অঢেল সম্পদ : নজরুল ইসলাম চেইনম্যানের কাজে নিয়োজিত থাকলেও তিনি থাকেন অর্ধকোটি টাকার বাসায়। ঘুরেন সাড়ে ২২ লাখ টাকার গাড়িতে। তার এক ছেলে লন্ডন থেকে সম্প্রতি এমবিএ করেছেন। আরেক ছেলে নগরীর বেসরকারি প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছেন। এরমধ্যে নগরীর ওআর নিজাম রোডের জুমাইরা পয়েন্টে ৪০৪ নম্বর ফ্ল্যাটটি স্ত্রীর আনোয়ারার নামে কিনেছেন তিনি। চিটাগাং শপিংয়ে থাকা তিন দোকানের মধ্যে দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত আনুকা ফ্যাশনও কেনা হয় স্ত্রীর নামে। যা তিনি ২০০১ সালে সাড়ে ৬ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করেন। একই বছরে মার্কেটের নিচতলার ৩৩ নম্বর ফ্যামেলি ফেয়ার নামের দোকানটিও ক্রয় করেন স্ত্রীর নামে। যার মূল্য দিতে হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। একই মার্কেটের দ্বিতীয় তলার ৩৭ নম্বর দোকানটিও তিনি ২০১৮ সালে ৮৫ লাখ টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে ক্রয় করেন। এছাড়া গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর মির্জাপুরে দ্বিতল বিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যাতে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে নজরুল দুদককে জানিয়েছেন। এর বাইরে স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের নামে একটি প্রাইভেট কার (চট্ট-মেট্রো-গ ১৩-২০১৫) ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেন।
এদিকে দুদক সূত্র বলছে, এসব তথ্য নজরুল দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে জানালেও এর বাইরেও তার ও স্ত্রীর নামে আরও বিপুল পরিমাণের সম্পদ রয়েছে। যার জন্য ফের অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাবে দুদক।

প্রসঙ্গত, গত ৭ নভেম্বর নগরীর ষোলশহর চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলার ‘আনুকা ফ্যাশন’ থেকে দুদকের অভিযানে নগদ সাড়ে সাত লাখ টাকা ও কোটি টাকার চেকসহ গ্রেপ্তার হয় নজরুল ইসলাম। এসময় তার কাছ থেকে ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার করে দুদক। একইসাথে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের গোপনীয় শাখার অফিস সহায়ক তসলিম উদ্দিনকেও গ্রেপ্তার করে দুদক। তার কাছ থেকেও নগদ ৫৭ হাজার টাকা পাওয়া যায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট