চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

‘লাম্পি স্কিন’র মহামারি রূপ চট্টগ্রামে

গরুর রোগ নিয়ন্ত্রণে নেই ভ্যাকসিন

ইফতেখারুল ইসলাম

১৪ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:০৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ মহামারি আকার ধারণ করেছে। অনেক খামারে গরু মারা গেছে। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি খামারে এই রোগের কারণে দুধের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এখনো এই রোগ নিয়ন্ত্রণে খামারিদের যথাযথ পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। রোগ নিয়ন্ত্রণে নেই কোন ভ্যাকসিন। চরম দুশ্চিন্তায় আছেন খামারিরা। বিভিন্ন গ্রামের খামারিদের সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, চলতি বছর থেকে গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত হতে শুরু হয়। প্রথমে গরুর চামড়ার উপরিভাগে টিউমারের মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। পরে তা মানুষের শরীরে হওয়া পক্সের মতো গুটি গুটি হয়ে শরীরে বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ছে। দু’তিনদিনের মধ্যে প্রাণির সারা শরীরে তা বড় বড় হয়ে ফেটে ঘায়ে পরিণত হচ্ছে। রোগাক্রান্ত গরু কোনো খাবার মুখে নিচ্ছে না। অনেক গরুর বুকের নিচে হওয়া গুটিতে পানি জমে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। পরে সেখান থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে বিস্তার লাভ করছে। এ রোগ ক্রমান্বয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে গরুটি মারা যাচ্ছে। কর্ণফুলী উপজেলার একটি ডেইরি ফার্মের মালিক নেভী হারুন

পূর্বকোণকে জানান, তার খামারে অন্তত ১৪টি গরু লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হয়েছিল। চিকিৎসায় তার গরুগুলো সুস্থ হয়েছে। তবে শিকলবাহা এলাকার জাহাঙ্গীর চেয়ারম্যানের খামারের একটি গরু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কর্ণফুলী উপজেলার মধুবাপের বাড়ি মাকসুদের খামারের একটি গরু মারা গেছে। কর্ণফুলী ভেল্লাপাড়া এলাকার কায়সারের খামারের একটি গরু মারা গেছে। এমন কোন খামার পাওয়া যাবে না যেখানে এই রোগ হানা দেয়নি। এই রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছে উল্লেখ করে বলেন, বড় গরু অনেক সময় বেঁচে যায়। তবে ছোট বাচুর আক্রান্ত হলে মরে যাওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে। আর গর্ভবতী গাভী আক্রান্ত হলে গর্ভপাত ঘটে যায়। গাভীর দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়। গরু শুকিয়ে যায়।

চিটাগং ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাঈম উদ্দিন পূর্বকোণকে জানান, পশু চিকিৎসক ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে না। সুনির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন না থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন খামারিরা। দ্রুত এ রোগের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মাংস ও দুধ উৎপাদনকারী খামারের অনেক গবাদি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খামারিরাও বিপাকে পড়বে। দ্রুত ভ্যাকসিন বের করা অতীব জরুরি উল্লেখ করে বলেন, দ্রুত উৎপাদন করতে না পারলে আপাতত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বিদেশ থেকে ভ্যাকসিন আমদানি করে খামারিদের সরবরাহ করার দাবি জানান।
লাম্পি স্কিন ডিজিজকে(এলএসডি): কেউ কেউ এই রোগকে কাউ ফক্সও বলেন। এই রোগটি বাংলাদেশে আগে দেখা যেত না। সম্ভবত এই বছরই প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। বাংলাদেশে গোট ফক্স আছে। কাউ ফক্স অনেকটা গোট ফক্সের মতই। জ¦র নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যথানাশক দিয়ে কিছুটা ব্যথা কমানো গেলে, ঘা না বাড়ার জন্য জীবাণুনাশক দিয়ে যদি পরিষ্কার রাখা যায় তাহলে রোগটি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকে। অনেক সময় সারা শরীরে ব্যাপক ঘা হয়ে যায়। সেকেন্ডারি ইনফেকশন হলে তা না বাড়ার জন্য এন্টিবায়োটিক দিতে হয়।

রোগের লক্ষণ : আক্রান্ত গরু প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং খাবার রুচি কমে যায়। জ্বরের সাথে সাথে মুখ দিয়ে এবং নাক দিয়ে লালা বের হয়। পা ফুলে যায়। সামনের দুই পায়ের মাঝ স্থান পানি জমে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গা চামড়া পিন্ড আকৃতি ধারণ করে, লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্টি হয়। ধারাবাহিকভাবে এই ক্ষত শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষত মুখের মধ্যে, পায়ে এবং অন্যান্য জায়গা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্ষত স্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। পাকস্থলী অথবা মুখের ভিতরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে গরু পানি পানে অনীহা প্রকাশ করে এবং খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।
রোগটি কিভাবে ছড়ায় : লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে রোগটি অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান মাধ্যম গুলো হচ্ছে : মশা ও মাছির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। গরুর লালা থেকেও ছড়ায়। আক্রান্ত গাভী থেকে বাছুর দুধ পান করলে সেই বাছুরও আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত গরুকে যে সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন দেয়া হয় সেটি দিয়ে সুস্থ গরুকে ইনজেকশন দিলেও ছড়াতে পারে। খামারে কাজ করা মানুষের পোশাকের মাধ্যমে আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভাইরাস আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেন এই রোগের অন্যতম বাহন।

জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ফরহাদ হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, শিকলবাহা এলাকায় প্রথম এই রোগ চিহ্নিত হয়। তিনি জানান, এটি ছাগলের রোগ। যাকে বলে গোট ফক্স। অতীতে বাংলাদেশে এই রোগ কখনো ব্যাপক হারে হয়নি। মূলত কোরবানির সময় থেকেই এই রোগ ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। যেহেতু চাহিদা ছিল না তাই ভ্যাকসিনও ব্যাপক হারে তৈরি হয়নি। বর্তমানে রোগ ছড়িয়ে পড়ার পর ভ্যাকসিনের সংকট তৈরি হয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। সরকার ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। তিনি জানান, এই রোগ শুধু চট্টগ্রামে নয়। দেশের অন্যান্য জেলায়ও দেখা দিয়েছে।

ইতিহাস : রোগটি ১৯২৯ সালে প্রথম জাম্বিয়াতে দেখা যায়। পরে তা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে এবং ২০১৪-২০১৫ সালের দিকে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, কাজাখস্থানসহ আশেপাশের দেশে দেখা যায়। ২০১৬ সালে লাম্পি ডিজিজ গ্রিস, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়ায়, সার্বিয়া, কসোভোতে ছড়ায়। চলতি বছর এশিয়া মহাদেশের চীন ও ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে দেখা যায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট