চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রামগড়-সাব্রুম বন্দরে খুলবে স্বপ্নের দ্বার

দ্রুত এগিয়ে চলছে ফেনী নদীতে মৈত্রী সেতুর কাজ

নিজাম উদ্দিন লাভলু হ রামগড়

৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ফেনীনদীর উপর মৈত্রীসেতু-১ এর নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ভারত সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন এ সেতুটির নির্মাণকাজ ২০২০ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। এটি নির্মাণ হওয়ার পরই বহু প্রতীক্ষিত রামগড় সাব্রুম স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু হবে। বাংলাদেশের ১৫তম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম এ স্থলবন্দর চালু হলে দুই দেশের ব্যবসা বাণিজ্য, পর্যটনসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ কারণে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে দুই দেশের মানুষ। অন্যদিকে, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সেভেন সিস্টারখ্যাত তাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ৭টি অনুন্নত রাজ্যের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে দেখছে মৈত্রী সেতুটিকে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর সাথে বৈঠকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর যৌথ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফেনীনদীর ওপর নির্মাণাধীন বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সেতু-১ নামে সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক উন্মোচন করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রামগড়-সাব্রুম স্থল বন্দর চালুর লক্ষ্যে সীমান্তবর্তী ফেনীনদীর উপর মৈত্রী সেতু-১ নির্মাণ কাজের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিলে আগরওয়াল কনস্ট্রাকশন নামে গুজরাটের একটি প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিযুক্ত করে ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়েস এন্ড ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (এনএইচআইডিসিএল) সংস্থাটি। নির্মাণকাজের নিযুক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের দুই লেন বিশিষ্ট এক্সট্রা ডোজড, ক্যাবল স্টেইড আরসিসি মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। রামগড় পৌর এলাকার মহামুনি এবং ভারতের সাব্রুমের নগর পঞ্চায়েতের নবীনপাড়া এলাকায় সীমান্তবর্তী ফেনীনদীর ওপর দ্রুত গতিতে চলছে সেতুর নির্মাণ কাজ।

সরেজমিনে সেতু নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ভারত দুই অংশেই বিরামহীনভাবে সেতুর কাজ করছেন ভারতীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ভারী ভেহিক্যাল, মেশিনারিজ এবং নির্মাণ সামগ্রী এপারে আনতে নদীর ওপর অস্থায়ী সেতু তৈরী করা হয়েছে।

কর্তব্যরত ভারতীয় প্রকৌশলী মতিউর রহমান সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বলেন, ৬৫ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, ৪১২ মিটার দীর্ঘ এ সেতুর মোট পিলার রয়েছে ১২টি। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে নির্মাণ করা হয়েছে ৮ টি ও ভারতের অংশে ৪টি। স্প্যান রয়েছে ১১টি। বর্তমানে বাংলাদেশ অংশে ৬টি, ভারতের অংশে দুটি এবং ৩টি মেইন স্টীল গার্ডার স্প্যানের কাজ চলছে। দৈনিক প্রায় ১৫০ জন শ্রমিক ও ১১জন প্রকৌশলী সেতুর নির্মাণ কাজে নিয়োজিত আছেন। তিনি জানান, সেতু থেকে ২৪০ মিটার এপ্রোচ রোড নির্মাণ করে রামগড়-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কে সাথে এবং ওপারে সেতু থেকে প্রায় ১২শ মিটার এপ্রোচ রাস্তা নবীনপাড়া-ঠাকুরপল্লী হয়ে সাব্রুম-আগরতলা জাতীয় সড়কে যুক্ত হবে। প্রায় ১০০ কোটি ভারতীয় রুপি ব্যয় করে সেতুটি নির্মাণ করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা যায়, অনুন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অতি দূরত্বের কারণে সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই সেদেশের সরকার রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর ও ফেনীনদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রামগড় থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বন্দরকে টার্গেট করেই তাদের এ পরিকল্পনা। ২০০২ সালের এপ্রিলে ভারতের মিনিস্ট্রি অব এক্সানাল এফেয়ার্স বিভাগ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফেনীনদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রথম প্রস্তাব দেয়া হয়। ২০১০ সালে নয়াদিল্লীতে ঘোষিত দুই দেশের যৌথ ইশতেহারের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদে রামগড়-সাব্রুমে স্থলবন্দর চালু করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। মৈত্রী সেতুর সাব্রুম অংশে নির্মাণ কাজ পরিদর্শনকালে সংবাদ মাধ্যমকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব বলেন, ফেনী নদীর উপর নির্মাণাধীন ফেনী ব্রিজ হবে ভারত বাংলাদেশ দু’দেশের বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন। ত্রিপুরা পাবে ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর। এ বন্দর ব্যবহার করে ত্রিপুরাতে অর্ধেক খরচে পৌঁছে যাবে প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী। ফেনী ব্রিজই দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের সেতুবন্ধন রচনা করবে। ত্রিপুরার বিরাট সমস্যার সমাধান হবে। এ ব্রিজ হয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী, রড, সিমেন্ট, ইটসহ প্রয়োজনীয় সব ধরণের সামগ্রী অল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে ত্রিপুরায় পৌঁছে যাবে।

জলপথ ব্যবহারের সুযোগের কারণে পণ্য পরিবহণ ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে। ভারতের অন্যান্য বাজার বা শহর থেকে ত্রিপুরায় উন্নয়ন সামগ্রীর দাম অনেক কমে পাওয়া যাবে। ব্যবসা বাণিজ্য এখানে প্রসার ঘটলে বাংলাদেশেও লাভবান হবে। ত্রিপুরার উন্নয়নে এখানবাসীর দীর্ঘদিনের যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন পুরণ করবে ফেনী ব্রিজ। মূখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে ত্রিপুরাসহ সাতটি রাজ্যের সংযুক্তির ‘গেটওয়ে’ হিসেবে ব্যবহার হবে ফেনী ব্রিজ। দু’দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে বাংলাদেশ থেকে প্রসাধন সামগ্রী, সরামিক ও মেলামাইল পণ্য, সিমেন্ট ,ইট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, তামাক জাতীয় পণ্য, শুঁটকি মাছ প্রভৃতি ত্রিপুরা রাজ্যে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে, ত্রিপুরা থেকে কাঠ, বাঁশ,পাথর, মশলা প্রভৃতি পণ্য আমদানি করা যাবে। প্রসার ঘটবে পর্যটন শিল্পের। সীমান্তের ওপারের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানাগেছে, মৈত্রীসেতু নির্মাণের সমানতালে সেখানকার অভ্যন্তরিন মহাসড়কের উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজও চলছে জোরেশোরে। গত ৩ অক্টোবর সাব্রুম থেকে আগরতলা রেল সার্ভিস চালু করা হয়েছে। সাব্রুমে স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তুলতে বিপুল পরিমাণ জমিও অধিগ্রহণ করেছে। রামগড় সাব্রুম স্থলবন্দর ও মৈত্রী সেতুকে সামনে রেখে ত্রিপুরাসহ সেখানকার রাজ্যগুলোর যোগাযোগসহ ব্যবসা বাণিজ্যের নানামুখি উন্নয়ন কর্মকা- চলছে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, রামগড় স্থলবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি ইতিমধ্যে একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এরপরই অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে।

এদিকে, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সরওয়ার উদ্দিন জানান, মৈত্রী সেতু ও এপ্রোচ রোড নির্মাণের জন্য ২.৮৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়েছে। বন্দরের বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনের জন্য ১০একর ভূমিসহ কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, বিজিবি ও পুলিশ চেক পোস্ট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম চলছে। রামগড় সাব্রুম স্থলবন্দরের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সড়ক হিসেবে ঢাকা চট্টগ্রাম মহা সড়কের বারৈয়ারহাট হতে রামগড় পর্যন্ত সড়কটি চার লেনে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে জাইকা কাজটি করবে। বর্তমানে এ সড়কে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ করছে জাইকা। চট্টগ্রামের নাজিরহাট হতে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট