চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টলপ্রেমী বাদল আর নেই

পূরণ হলো না কালুরঘাট সেতু নির্মাণের স্বপ্ন কাল চট্টগ্রামে তিনটি নামাজে জানাজার পর বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন

সেকান্দর আলম বাবর হ বোয়ালখালী

৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ৩:০৭ পূর্বাহ্ণ

আর শোনা যাবে না ক্ষুরধার বক্তব্য, ইতিহাসের পরতে পরতে বিচরণ করে আহরিত রসটুকু আর মানুষের মাঝে বিলি হবে না এমনভাবে। সংসদে বক্তব্য শুনার ব্যাকুলতা নিয়ে টিভি সেট অন করা হবে না, সবকিছুকে পেছনে ফেলে চলে গেলেন তিনি। তাঁর চলে যাওয়াটার স্বাভাবিক কারণ তিনি অভিমান করেছেন, বড্ড অভিমান। চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে বারবার পেছনে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। নিজ এলাকার মানুষের দুর্ভোগ লাগবে একটা কালুরঘাট সেতুর দাবি দিয়ে এমনিতেই তিনি জনগণের কাতারে চলে এসেছেন বারেবারে। জনগণও তাঁকে ভালভাবে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম নিয়তি স্বপ্ন দেখিয়ে কালুরঘাট সেতুটা তিনি নির্মাণ করে যেতে পারেননি। বক্তৃতায় একটি কমন কথা থাকতো তাঁর, মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছি। তিনি আর কেউ নন, চট্টগ্রাম ৮ আসনের সাংসদ, জাতীয় নেতা মঈন উদ্দিন খান বাদল। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ভোর ৭.৪৫ টার দিকে ভারতের বেঙ্গালুরুর নারায়ণা হৃদরোগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট এন্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান (ইন্নালিল্লাহে….. রাজেউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি তিন ছেলে, এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী এস এম হাবিব বাবু জানান, গত ২৫ অক্টোবর থেকে ভারতে প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ পরিবারের উদ্ধৃতি দিয়ে গতকাল রাত সাড়ে আটটায় সাংবাদিকদের জানান, সাংসদ বাদলের মরদেহ ভারত থেকে দেশে আনতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর মরদেহ শুক্রবার সন্ধ্যা ৮.৩৫ টায় ঢাকা হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছাবে। ৯ নভেম্বর সকালে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম নামাজে জানাজা, এরপর শহীদ মিনার ও দলীয় কার্যালয়ে সর্বস্তরের জনতার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য লাশ রাখা হবে। দুপুরে তাঁর লাশ চট্টগ্রামে পৌঁছাবে। ৩টায় জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদে চট্টগ্রামের ১ম জানাজা, বাদ আছর বোয়ালখালীর সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ মাঠে ২য় জানাজা, বাদ মাগরিব নিজ গ্রামের সারোয়াতলী ইব্রাহিম নূর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩য় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

মঈন উদ্দিন খান বাদলের জন্ম ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। পিতা আহমদুল্লাহ খান ছিলেন ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা। সর্বশেষ ডিএসপি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মাতা যতুমা বেগম ছিলেন বরাবরই গৃহিনী, সময়ের রত্মগর্ভা। তিনি তাঁর পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তৃতীয়। পিতার কর্মক্ষেত্রের কারণে মঈন উদ্দিন খান বাদলকে কাটাতে হয় দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে আসা যাওয়াতে। পড়াশুনা করেছেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। কলেজ জীবন শেষ করেন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে জড়িয়ে পরেন মুক্তিযুদ্ধে। প্রশিক্ষণ নেন ভারতের জেনারেল সুজন সিংহ উবানের কাছে উনার হেডকোয়ার্টার রাঙামাটিতে। ওইসময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা এস এম ইউছুফ। ষাটের দশকে আওয়ামী ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিক পথচলা। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা বাদল একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবনবাজী রেখে লড়েছেন দেশমাতৃকার জন্য। বাঙালিদের ওপর আক্রমণের জন্য পাকিস্তান থেকে আনা অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে খালাসের সময় প্রতিরোধে এ ডব্লিউ চৌধুরী বীর উত্তম, বীর বিক্রমসহ অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাজনীতি ও বিভিন্ন কারণে অনেক দেরীতে ১৯৮৫ সালের দিকে চাঁদপুরের সেলিনা খানকে বিয়ে করেন তিনি। রাজনীতির চড়াইউৎরাই পার করতে গিয়ে আর্থিক অস্বচ্ছলতায় জীর্ণকুঠিরে ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকতেন পরিবার নিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাদল সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। জাসদ, বাসদ হয়ে পুনরায় জাসদে আসেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর কার্যকরী সভাপতি মঈন উদ্দিন খান বাদল। একজন দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন তাঁর কর্মদক্ষতা দিয়ে। চার দলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মার্চ জাতীয় সম্মেলনে জাসদ (ইনু) সর্বশেষ ভাঙ্গনের ফলে ইনুর কমিটির বিরুদ্ধে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি, নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক এবং নিজেকে কার্যকরী সভাপতি ঘোষণার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দলকে চালিয়ে গিয়েছেন এ বাগ্মী সাংসদ। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত এ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম-৮ সংসদীয় আসন থেকে মহাজোটের নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। জীবনের শেষ বয়সে এসে কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ডিসেম্বরের মধ্যে না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন। গত ৭ সেপ্টেম্বর সংসদের পার্লামেন্ট মেম্বার ক্লাব লবিতে জীবনের অন্যতম অর্জন সংসদে দেয়া জ্ঞানগর্ভ ভাষণের সংকলন ঢাকায় ‘সত্যের স্পর্ধিত উচ্চারণ’ গ্রন্থের মোড়ক উম্মোচন করে তিনি জাতির জন্য রেখে গেছেন সত্য ভাষণের অনন্য উদাহরণ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনেও বাদলের উল্লেযোগ্য ভূমিকা ছিল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট