চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হলেই মামলা

সক্রিয় শতাধিক প্রতারক চক্র মামলায় ভূমি মালিকের ক্ষতি পূরণের টাকা আটকা ৫-১০ শতাংশ কমিশন দাবি

ইমরান বিন ছবুর

৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:৫১ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে সক্রিয় রয়েছে শতাধিক ‘প্রতারক চক্র’। কোথাও কোন ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হলে সেখানে গিয়ে হাজির হয় এ চক্রটি। প্রথমে চক্রটি ক্ষতিপূরণ বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে মোটা অংকের কমিশন দাবি করে। দাবি না মানলে তারা মূল ভূমি মালিকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে।

মামলার কারণে এক পর্যায়ে ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে আদালত। এর ফলে বাধ্য হয়ে ভূমি মালিকরা এই প্রতারক চক্রদের প্রস্তাবে রাজি হয় এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে কমিশন প্রদান করতে বাধ্য হয়। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এল এ শাখা ও ভুক্তভোগীদের তথ্য মতে, নগরীতে শতাধিক ভূমি প্রতারক রয়েছে। যাদের কারণে রিং রোড, বে-টার্মিনালসহ বেশ কিছু প্রকল্পের ক্ষতিপূরণের অর্থ আটকে আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূমি অধিগ্রহণ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, বিভাগ মামলা নং-৬২১/২০১৪ ইং, ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের মামলায় এক মালিকের ৪৩ জন ওয়ারিশ কয়েকজন গং দিয়ে ১ হাজার ৫৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলার বাদিরা ১ হাজার ২১৬ একর জমির মালিক দাবি করছে, যার মূল্য দেখিয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। ভূমি দালাল চক্রের ফাঁদে পড়া দক্ষিণ হালিশহর এলাকার ভুক্তভোগী মো. আব্দুল হক জানান, রিং রোডের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হলে আমরা কাগজপত্র নিয়ে ডিসি অফিসের এল এ শাখার সাথে যোগাযোগ করি। সব প্রসেসিং শেষ হওয়ার পর ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার আগে কিছু ভূমি প্রতারক বা চক্র আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা আমাদের কাছে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন দাবি করে। টাকা না দেয়ায় তারা মামলা

করে দেয়। যার ফলে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। মামলা করার পরও তারা আবার আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং কমিশন দিতে রাজি হলে মামলা তুলে নেবে বলেও জানায় তারা। যাদের মামলার বাদি করা হয়েছে, কয়েকজন ছাড়া সব ভুয়া। তারা কেউ স্থানীয় বাসিন্দা না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এ দালাল বা প্রতারক চক্রের সাথে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও জড়িত রয়েছে। তাদের সাহায্য নিয়ে কাগজপত্র তুলে এ মামলা করে প্রতারকরা। নগরীর অন্যান্য জায়গার তুলনায় হালিশহর এলাকায় এসব প্রতারকের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী ও সিটি আউটার রিং রোডের প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বিন শাম্স বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে ভূমি মালিক ক্ষতিপূরণ না পেলে জোর করে তাদের ভূমি দখল বা ভূমিতে কাজ করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা এবং আদালতের কিছু ধারা ব্যবহার করে ভূমিদস্যু বা প্রতারকরা সরকার কোন প্রকল্প গ্রহণ করলেই ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার আগে তারা ভূমি মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করে। ফলে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন ক্ষতি পূরণের অর্থ দেয়া বন্ধ করে দেয়।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, এসব ভূমিদস্যুদের সাথে জেলা প্রশাসনের এল এ শাখার কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত রয়েছে। যাদের ব্যবহার করে ভূমি দস্যুরা এ মামলার সুযোগ নেয়। সিডিএ’র রিং রোড প্রকল্পে এইসব ভূমিদস্যুরা প্রকৃত ভূমি মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে কিন্তু সিডিএকে মামলার বাদি করেনি। তারা বাদি করেছে জেলা প্রশাসন ও ভূমি মালিকদের। ফলে আমাদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারিনি।

কাজী হাসান বিন শাম্স আরো জানান, রিং রোড প্রকল্পে সড়কের কিছু অংশের এবং ফিডার রোডের ৫০ শতাংশসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পের ক্ষতিপূরণের অর্থ সিডিএ নিজে প্রদান করেছে। ফলে ওই অংশে বা প্রকল্পে দ্রুত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মামলা জটিলতায় ফিডার রোডের কাজ করতে পারছি না। ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনকে দিলেই সেখানে একটি চক্র এসে মামলা করে দেয়।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ শাখা) আমিরুল কায়সার জানান, কোন জায়গা নিয়ে মামলা থাকতে আদালতের নিষেধাজ্ঞার ফলে জেলা প্রশাসন ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করতে পারবে না। ভূমি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, আট ধারা নোটিশ জারির পর কোন মামলা করা যাবে না। পূর্বে যতগুলো মামলা হয়েছে, অধিকাংশ আট ধারা নোটিশ জারির পর হয়েছে।

ভূমিদস্যু বা প্রতারকদের ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানান, আমরাও আসলে শুনেছি কিছু সংখ্যক লোক ভূমি অধিগ্রহণ শুরু মামলা করে। তবে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কারো নামে তথ্য বা প্রমাণ নেই।

জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা সূত্রে জানা যায়, এলএ ম্যানুয়েলের ১৯৯৭ এর ৫০ ধারাকে ব্যবহার করে প্রতারকরা এই মামলাগুলো করে থাকে। অনুচ্ছেদ ৫০ এ বলা আছে, কোনো ভূমি নিয়ে মামলা থাকলে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করা যাবে না।

এলএ সূত্র আরো জানায়, ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয় তিন ধারা নোটিশ দিয়ে, আর শেষ হয় সাত ধারা নোটিশ দিয়ে। সাত ধারা নোটিশ যখন আসে, তখন দালাল এসে সমবেত হয়। তারা (দালাল) ভূমি মালিকের কাছে টাকা দাবি করে। তারা ভূমি মালিককে বলে, আপনি যত টাকা পাচ্ছেন আমাদের মোট টাকার ৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ দিতে হবে। ভূমি মালিক যদি তাদের প্রস্তাবে রাজি না হয়, ভূমি মালিকের কোনো আত্মীয়-স্বজন ধরে মামলা করে দেয়। যার ফলে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় মূল মালিকের টাকা আটকে যায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট