চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

খসড়া গল্প

নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ

৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১৩ পূর্বাহ্ণ

ঘুম থেকে ওঠামাত্র যথারীতি কার্যক্রম শুরু। তার রুটিন মাফিক কাজ। স্বাভাবিক নিয়মে তিনি করে যাচ্ছেন। নাটকীয় কিছু না ঘটলে তার ব্যতয় ঘটে না। ইদানিং সদ্য কৈশোর পেরোনো তার দুই ছেলেও পিতার কাজের সহযোগী। দেবদূতের মত চেহারা নিয়ে তারা পিতার শ্রম-লাঘব করবার চেষ্টায় আছে। আমাদের তিনি অবশ্য একাই একশ। কালকের কাজ আজকে করেন। আজকের কাজ এখুনিই করেন। যাকে বলে কি না এক কথায় করিৎকর্মা। সকালে উঠে তিনি যদি দেখেন তার দ্বারা কারো উপকার হচ্ছে তাহলে একেবারে হুলস্থূল কা- বাঁধিয়ে বসবেন। কারো ন্যূনতম উপকারই যদি তার দ্বারা ভুলবশত হয়ে থাকে তক্ষুণি তার প্রতিবিধান করা চাই। তার গাছের ছায়ায় কারো আদার ফলন ভালো হচ্ছে কিংবা তার জমির আল দিয়ে গ্রামের বাচ্চারা স্কুল যাচ্ছে। তাহলে সর্বনাশ! কাজের ছেলে মোহাব্বতকে তিনি তখন প্রচলিত অর্থে মোহাব্বত করবেন না। মোহাব্বত করবেন সেদিন অন্যরকম। গাছের বেয়াড়া ডালপালা মুহূর্তেই সাফ। বই-শ্লেট বগলে আর মাথায় তেল ছপছপে শিশুর দল স্কুল যাওয়ার অপ্রয়োজনীয় চিন্তাটি বাদ দেয়।

অন্যরকম ছুটিতে তাদের চোখমুখ চঞ্চল হয়ে ওঠে। শত হলেও তিনি আমাদের গাঁয়ের লোক। ছিঃ আমরা কি এমন করে বলবো তার কাজের মধ্যে থাকে কারো বাড়া ভাতে ছাই কিংবা পাকা ধানে মই দেয়ার মতো মহৎ পরিকল্পনা? তিনি আমাদের আমরা তার। পাশের গ্রাম চর রিগ্যান, চর বৈকুণ্ঠবিলাসে তার মত আরেকজন আছেন ? এ জন্য কি আমরা গ্রামবাসী গর্ব করতে পারি না? আমরা গ্রামবাসী তাকে নিয়ে গর্ব করি প্রকাশ্যে আর ভয় করি অবশ্য গোপনে। তিনি মাঝে মাঝে আড্ডায় আক্ষেপ করেন জীবদ্দশায় তার মূল্যায়ন হচ্ছে না। আমরা ভরসা যুগিয়ে বলি,‘দাদা,সত্যিকার বড় মানুষের মূল্যায়ন মৃত্যুর পরেই হয়। শ্রীকলসী গ্রামের লোকজন একদিন হাড়ে হাড়ে বুঝবে আপনি কি ছিলেন।’ আরেকটু বাড়িয়ে বলি, ‘জানেন তো জাতি হিসেবে আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ তখনইতার চোখেমুখে খুশি খুশি ভাব উঁকি দেয়। আর আমরা যারা বেহায়া-বেল্লিক তাদের জন্য চা আর তক্তা বিস্কুটের অর্ডারটি দ্রুত দিয়ে দেন। বড় রোজ বিস্কুটকে তক্তার মত দেখায় বলে গ্রামে তা তক্তা বিস্কুট নামে পরিচিত। তার দরবারে গেলে চা-তক্তা বিস্কুট থাকবেই। দুধের সরের চায়ের সঙ্গে বিস্কুট চুবিয়ে চুবিয়ে খাওয়া। আমাদের লোভটাও সেখানে।

তবে গ্রামবাসীদের কেউ কেউ আড়ালে-আবডালে বলে থাকে তার মতো প্রতিভাকে কেবল চিড়িয়াখানায় মানায়। নদী সিকস্তীগ্রাম শ্রীকলসী । মেঘনা পারের এ-গ্রামে অভাব-অনটন লেগে থাকলেও একসময় আনন্দ ছিল। এখন তার পরিবর্তে জেঁকে বসেছে চাপা আতঙ্ক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কেউ হয়তো বলবেন; জমিদারী উঠে গেছে সে কবে কিন্তু এসব নদীসিকিস্তি অঞ্চলে কান পাতলেই জমিদারের পদধ্বনিশোনা যায় এখনো ।
শ্রীকলসীর হাটে চোখে লেগে থাকা বড় বোয়ালটি, সূর্যোদয়ের মত চকচকে চর্বিওয়ালা লাল মোরগটি, ফলের দিনে আফ্রিকার মানচিত্রের মত বড় কাঁঠালটি তার জন্য বরাদ্দ থাকতে হবে। তিনি একান্তভাবে না কিনলে তবে অন্যরা সাহস করতো কিংবা করে। থানা সদরের বড় সাহেবদের সঙ্গে তার ভীষণ ওঠাবসা। সাহেবদের প্রয়োজনে তিনি একপায়ে দাঁড়ানো। সাহেবদের কাছে মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত তিনি হাজির। সাহেবরাও তাকে পছন্দ করবেন না কেনো? তিনি কি তেমন অসামাজিক লোক? সত্যি সত্যি সাহেবরা তাকে পছন্দ করেন। দুর্মুখরা যদিও বলে সাহেবরা তাকে পছন্দ করেন না করেন তার তার অন্যকিছুকে । সুদিনে তার বাড়িতে ভোজ সভা লেগেই থাকে। সুদিন বলতে নদীসিকিস্তি এসব অঞ্চলে অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন সময়টাকে বোঝায়। বছরের এ-কয় মাস এখানে বিয়েশাদি-ঘরবাড়ি তৈরির মত খানাপিনারও সুদিন। বিশ/বাইশ কেজি ওজনের কোরাল, মোটাতাজা হাঁসের স্যুপ, ভেড়ার সুস্বাদু রোস্ট, বটের কষের মত গাঢ় দুধ, গাওয়া ঘি, দধি, বিশুদ্ধ ছানার রসগোল্লা, কালোজিরা ধানের সুগন্ধী চাল আর খেজুর রসের পায়েসের লোভনীয় আমন্ত্রণে সাহেবেরা সাড়া না দেন কি করে! বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন দপ্তরের সাহেবদের কাছে তিনি ‘ফ্রেন্ড গাইড অ্যান্ড ফিলোসোফার।’ অন্তত উপকূলীয় অঞ্চল বিষয়ে। বলা যেতে পারে ‘তুমি যে তোমার তুলনা।’

থানার বড় সাহেবের তিনি রামভক্ত হনুমান। মাস কয়েক আগের ঘটনা। থানার সামনে মাঠের মত জায়গাটায় বড় সাহেবের বাবার জানাজা। বিভিন্ন চেয়ারম্যান, মেম্বার, পুলিশ, চৌকিদার সহ গণ্যমান্য অনেকে উপস্থিত। আমরা জানতাম না। তিনিই অনেকটা জোর করে আমাদের নিয়ে গেলেন। যখন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামানো হল। কফিনের ওপর আছড়ে পড়ে তার সে কী কান্না । মারা গেলেন থানার বড় সাহেবের বাবা। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন আমাদের তিনি। এক পর্যায়ে বড় সাহেব তাকে পিঠ চাপড়ে সান্ত¦না দিচ্ছেন, ‘কারো বাবা-ই চিরদিন বেঁচে থাকে না।’ ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সহসা বেকুব বনে গেলাম। পরে বুঝে নিলাম আমরা বেকুব হলেও তিনি বেকুব নন। কখন কোথায় কি করতে হবে তাতে তিনি বিন্দুমাত্র ভুল করেন না। এমন পরীক্ষা তিনি অনেকবার দিয়েছেন। যেখানে এসআই, কনেস্টেবল বুঝতে কিছুটা সময় নেন; সেখানে বড় সাহেবের ইশারা মুহূর্তে তিনি বুঝে ফেলেন। হাজতে কাকে ঢুকাতে হবে কাকে ছেড়ে দিতে হবে; দরাদরিটি কেমন হবে তা থানার অন্যদের চেয়েও আমাদের শ্রীকলসী গ্রামের তিনিই ভালো বুঝেন। থানার কাকে কেসের আইও নিয়োগ করতে হবে, এফআইআর-এ কার নাম থাকবে, ফাইনাল চার্জশিটে কার নাম বাদ যাবে, কেসের ধারা কি কি হবে- এসব বিষয়ে বড় সাহেবের অলিখিত উপদেষ্টা তিনি। গ্রামের কে হুন্ডির ব্যবসায় জড়িত, কার গরু-মহিষের বাথান আছে, কার ঘরে ধান বেচার টাকা এসেছে ইত্যকার সংবাদ তিনি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে থানায় পৌঁছে দেন। কখনো কখনো চর্বির রোশনাই আর মেদের পাহাড়ে ডুবতে থাকা সাহেবের বিবিও পরাজয় শিকার করেন তার কাছে । বিবির কথা ফেললেও বিচক্ষণ বড় সাহেব আমাদের তার কথা ফেলেন না। গোপনে গোপনে প্রবাসীর স্ত্রী কিংবা কোন তরুণী বিধবাকে বড় সাহেবের জন্য ম্যানেজের কানাঘুঁষা রয়েছে বৈকি। সাহেবের বিবিও মানে ভাবী কি তাকে কম মূল্যায়ন করেন! তার আদব-লেহাজে ভাবী একদম মুগ্ধ। কারণ আমাদের তার ঠোঁটে হাসি প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স। ভুবন ভুলানো সে হাসি ছড়ানো দন্তপঙ্ক্তি? কি যে বলেন জুঁই ফুলকে দিব্যি হার মানায়। সাফারী আর সানগ্লাসে তিনি কেবল শ্রীকলসী গ্রামের নন পুরোদস্তুও মেঘনা মোহনাকে আলোকিত করে রেখেছেন! শ্রীকলসী গ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিছু থাক বা না থাক আমাদের তাকে নিয়ে বর্তমান বেশ উজ্জ্বল।
সেবার ইলিশের মৌসুম তখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। তবে হবে হবে করছে। বর্ষা নেমেছে অগ্রিম বলা যায় শৈশব না পেরুতেই বর্ষার যৌবন। জেলে পাড়ার লোকজন ঘর মেরামত করবে না কি জাল-নৌকা মেরামত করে মাছ শিকারে নামবে ? জেলেপাড়া বলতে আলাদা কোনো পাড়া বা লোকালয় নয়। বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে কোন রকম মাথা গুঁেজ থাকাত্রিশ/পঁয়ত্রিশটি পরিবার। কবুতরের খোপের মত ঘরগুলিতে কিভাবে এত লোক ঠাসাঠাসি করে থাকে পাড়ায় না গেলে বোঝা যায় না। পাড়া বলতে পেটফোলা অগণিত শিশু, বুক শুকিয়ে যাওয়া মায়ের দল, নদীতে রাতজাগা চোখলাল পুরুষমানুষ, হাড় জিরজিরে হাঁপানী-কাশির বুড়ো-বুড়ির বিচিত্র সমাহার। সেদিন শনিবার। সর্দার কৃপাসিন্ধু জলদাসের ঘরের সামনে উঠোনের মত সামান্য জায়গাটি আছে সেখানে প্রতি শনিবারের মত শনিপুজো। তবে উপস্থিতি কম। সর্দার বলতে জেলে পাড়ার মাতব্বর। কৃপাসিন্ধু বংশানুক্রমে সর্দার। তার বাবাও ছিলেন সর্দার। জেলে পাড়ায় সবাই তাকে মান্য করে। সর্দার হলেও তার আর্থিক অবস্থা অন্যদের চেয়ে ভালো নয়। শনি পুজোর প্রসাদ নিয়ে ছেলে বুড়ো কয়জন যার যার ঝুপড়িতে ফিরেছে। দমকা বাতাসে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে জেলে পাড়ায় তখন অন্যান্য রাতের মত একটি সাধারণ রাত। পাটকাঠির বেড়া, শণ কিংবা সস্তা টিনের ছাউনির ঘরগুলোতে কুপিবাতি, টিনের হ্যারিকেনের নিবু নিবু অবস্থা। সেদিন সপ্তমী কি অষ্টমী তিথি। নদীতে মাছশিকারে মন্দাবস্থা। পাড়ার লোকেরা যাকে বলে ‘ডালা’। রাতের বেলায় নদীতে যায়নি কেউ। কেঁপে কেঁপে ওঠা আলোয় পুরুষেরা কেউ তাস-লুডুতে মগ্ন। কেউ সস্তা মোবাইলে সময় কাটাচ্ছে। মেয়েদের কেউ কেউ রান্না চড়িয়েছে, কেউ শিশুদের ঘুম পাড়াচ্ছে। কেউ পাটের রশি দিয়ে দিয়ে শিকে তৈরির চেষ্টায় আছে।

বাতাসের ঝাপ্টার সঙ্গে হঠাৎ মানুষের চিৎকার মিশে এক ভয়ঙ্কর সোরগোলে কেঁপে কেঁপে উঠল পাড়াটি। সোরগোলের কেন্দ্রস্থল প্রথমে চিহ্নিত করতে না পারলেও পরক্ষণেই চিহ্নিত হয়। যে যেখানে ছিল সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল সর্দারের ঘরের দিকে। বছর খানেক আগেঠেঙ্গার চরে মাছ ধরতে গেলে নৌকোর ইঞ্জিনের পাখায় সর্দারের পা কাটা পড়ে। দুই বউ এর সংসার, এতগুলো ছেলেমেয়ের মুখের অন্ন যোগানো এসব সামলাতে সামলাতে ঔষদ-পথ্য তেমন একটা হয়নি সর্দারের। আর সর্দারও আর উঠে দাঁড়াননি। শনি পুজোর পরপরই শ্রীকলসী গ্রামের জেলেপাড়া সর্দারহীন হয়ে পড়ে। পুরো পাড়া ভেঙে পড়েছে সর্দারের উঠোনে। পাশে কয়েক ঘর মুসলমান মাঝি-মাল্লা আছে। তারাও ছুটে আসে। বৃষ্টি আর বিলাপ কিছুটা থিতিয়ে এলে হঠাৎ সমস্যাটি উন্মোচিত হয় বিকট চেহারা নিয়ে। নদীর করাল গ্রাসে উপদ্রুত এসবলোকেরা শুধু জীবিতদের নিয়েই চিন্তা করেছে। মৃতদের নিয়ে চিন্তা করবার সুযোগই বা কোথায়। এখানে আসা তিন/চার বছরের মধ্যে শ্মশানের প্রয়োজন হয়নি। ভেঙে যাওয়া জেলে পাড়ায় তাদের নিজস্ব শ্মশান না থাকলেও নদীর পাশে চিতা সাজাতে পারতো। বর্তমানে এ ঘনবসতি পূর্ণ বেড়ি বাঁধে তা সম্ভব নয়। এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে কি করতে পারে জেলেপাড়ার লোকজন ? পাশের গ্রাম চর বৈকুণ্ঠবিলাসে পারিবারিক শ্মশান আছে এমন দু’একজনের কাছে ইতোমধ্যে মোবাইল সাহায্য চাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঠাকুর বাড়ির লোকজন, সাহাপাড়ার লোকজন মিষ্টিকথায় জেলেপাড়াকে না করে দিয়েছে। রাতে সৎকার করতে না পারলে বাসি-মরা হয়ে যাবে। কিন্তু রাত পোহালেও সৎকারের ব্যবস্থা কোথায়? এতক্ষণ যারা ব্যস্ত ছিল তাদের মুখে মুখে পৃথিবীর সমুদয় অন্ধকার নেমে এসেছে। শুধু কি তাই ? কিয়ৎক্ষণ পরেই পাড়ার লোকজন উপলব্ধি করবে তাদের জন্য ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষমাণ। মোবাইলের ঘড়িতে তখনো বারোটা বাজেনি। সর্দারের ছেলের মোবাইলে আমাদের তার কল। তার মানে জেলে পাড়ায় এবার সত্যিকার বারোটা বাজবে। অপ্রস্তুত সর্দারপুত্র মোবাইল রিসিভের পর প্রথমে কয়েক মুহূর্ত বাক্হীন থাকার পর যা প্রকাশ করলো। তা জেলেপাড়াকে এমুহূর্তে আতঙ্কিত করার জন্য যথেষ্ট। ঠিক মরা ওপর খাড়ার ঘা। তিনি আসবেন সিন্ধু সর্দারকে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য। সামাজিকতার দিক থেকে তার আগমন স্বাভাবিক এবং সাধুবাদও পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু যার বাপকে কুমিরে খেয়েছে সে ঢেঁকি দেখলে ভয় পায়। জেলেপাড়ার লোকজনের মত যারা ভুক্তভোগী তারাই জানে এ-সামাজিকতার মানে কি। গেল নির্বাচনে তিনি গো হারা হারার জন্য যাদের দায়ী বলে মনে করেন সর্দার তাদের অন্যতম। সর্দারের প্রভাব কেবল জেলেপাড়ায় নয় বেড়ি বাঁধের মুসলমান ভোটারদের মধ্যে ছিল। কাজেই প্রতিশোধ নেয়ার এখনই মোক্ষম সময়। নির্বাচনের বিরোধিতার জন্য অন্যেরা একে একে প্রতিশোধের শিকার হয়েছে। এবার সর্দারের পালা। আসন্ন প্রতিশোধের আঁচ লাগতে থাকে। কেঁপে কেঁপে ওঠে জেলেপাড়া। পুরুষদের মুখে আপাতত শব্দ নেই। সদ্য শোক অপ্রত্যাশিত সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। মহিলাদের সম্মিলিত বিলাপ থেকে মর্মোদ্ধার করলে বোঝা যায়; ‘এবার ভক্তির সঙ্গে গঙ্গাপুজো করা যায়নি বলে বিপদ ঘাড়ে চেপেছে। মা গঙ্গা রুষ্ট হয়েছেন।’ ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও এমন বিপদ জেলেপাড়ায় আর নেমে আসেনি। শোকের উচ্ছ্বাস, সঙ্কটের তীব্রতা আর বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারাপাত রাতের অন্ধকারকে দুর্বোধ্য এবং রহস্যময় করে তুলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে মুখ খোলে সবাই। বেরিয়ে আসে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিশোধের সম্ভাব্য চিত্রনাট্য। প্রথমত হতে পারে সর্দারের সংসার দুটির ছেলেদের নিয়ে বিবাদের বিষয়টি। সর্দারের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। থানায় নির্ঘাত মার্ডার কেস। দ্বিতীয়ত হতে পারে আমাদের তিনি সর্দার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পান। অর্থ আদায়ের মামলা। রাত পোহালেই জেলেপাড়ায় পুলিশ। থানা-পুলিশ-মামলার কথা শুনে অনেকে ভয়ে কাঠ। তৃতীয়ত কি হতে পারে এমনটি শেষ না হতে ভোরের পাখিরা ডেকে ওঠে। পুুরানো মৃদঙ্গ আর কাঁসর নিয়ে ততক্ষণে মৃতদেহের পাশে কীর্ত্তন শুরু হয়ে যায়। প্রভাতী কীর্ত্তনের সুর জেলেপাড়ায় আরেকটি নূতন দিনকে স্বাগত জানায়। ‘ভক্ত-বাঞ্চা পূর্ণ করে নন্দের নন্দন/মথুরায় কংসধ্বংস লঙ্কায় রাবণ।’ শোকাহত-আতঙ্কিত-বিনিদ্র কণ্ঠে কীর্তনের এমনপদ তাৎপর্যময়। সুদূর মথুরা কিংবা লঙ্কার নন শ্রীকলসী গ্রামের তিনিই জেলেপাড়ায় কংস কিংবা রাবণ। কীর্ত্তনের রেশ শেষ না হতেই তিনি রেনকোট-রেনবুট পড়ে হিরো-স্পেন্ডেল থেকে নামেন। শুরু হয়ে যাবে এখনি কয়েকশ কিমি বেগে ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভয়ঙ্কর মাত্রার ভূমিকম্প। শেষ রাতের দিকে মঙ্গলীর মা বুড়ি নাকি-সুরে বিলাপ করছিল, ‘সর্দার গেছে তো গেছে বেকেরে এক্কারে ল-ভ- করি আলাইবো।’ তা হলে মঙ্গলীর মা বুড়ির কথা সত্যি হচ্ছে!

তবে অন্যরকম ল-ভ- হয়েই গেল। তাৎক্ষণিক ভাবে প্রতিশোধ নিতে কম নেন নি। প্রতিপক্ষ মৃত সিন্ধু সর্দার সঙ্গে পুরো জেলেপাড়ার ওপর ভয়ানক প্রতিশোধ। চাচাতো ভাইমফিজ ব্যাপারীকে জলদি তলব করলেন। মফিজ থেকে নগদ চড়ামূল্যে কড়াখানেক জমি কিনে দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তা ঘোষিত হল জেলে পাড়া সর্বজনীন শ্মশান হিসেবে। পরক্ষণেই তিনি হাওয়া। জেলেপাড়ার লোকজন বুঝুক বা না বুঝুক সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে পুরোহিত প্রবর প্রফুল্ল চিত্তে প্রকাশ করলেন, ‘জমিটি এখন জমি নেই তীর্থে পরিণত হয়েছে। দেবাদিদেব মহাদেবের অধিষ্ঠান! যা কিনা সাক্ষাৎ প্রয়াণ তীর্থ।’ কিছুক্ষণ আগেও যিনি এখানে পদার্পণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। অনেকেই ছুটে এল চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে । বৃষ্টির রেশ শেষ হতেই মন্ত্রোচ্চারণ-মুখাগ্নি তারপরলক লক করে ধরে উঠলো চিতার আগুন। আমরা যেতে যেতে শ্রীকলসী গ্রামের একজন সাহসী লোক সর্দারের নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে মিশে গেল। আমরাও প্রথম বারের মত চা-তক্তা বিস্কুটের লোভ ঝেড়ে ফেলে আমাদের তার উদ্দেশে পা বাড়ালাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট