চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

১০ খাদ্য গুদাম সিলগালা

খাদ্য বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভালোমানের চাল পাচার হচ্ছে খোলাবাজারে। আর গুদামে পড়ে থাকে নি¤œমানের চাল

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:২২ পূর্বাহ্ণ

দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামে ১০ গুদাম সিলগালা করে দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন মন্ত্রী। নি¤œমানের খাদ্য মজুদ রাখা ও গুদামে পোকা-মাকড়ের প্রাদুর্ভাবের অভিযোগে তা সিলগালা করার নির্দেশনা দেন মন্ত্রী।

গতকাল বিকেল ৫টার দিকে খাদ্যমন্ত্রী অভিযান চালান দেওয়ানহাট সিএসডি খাদ্যগুদামে। দেওয়ানহাট সিএসডিতে ৬৩টি গুদাম রয়েছে। এরমধ্যে ১০টিতে ভাঙা, নি¤œমান ও চাল সংরক্ষণ করা এবং অপরিষ্কারের কারণে পোকা-মাকড়ের প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি অভিযোগে সিলগালা করার নির্দেশনা দেন তিনি। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘গুদাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় পোকা-মাকড় রয়েছে বলে মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগের তদন্ত করার জন্য ১০টি গুদাম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী মহোদয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা গুরুতর কোন অভিযোগ নয়, রুটিন ওয়ার্ক।’

সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থান সরকারি সংগৃহীত করা নি¤œচাল সংগ্রহ করে গুদামজাত করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দীঘদিন ধরে খাদ্য বিভাগে অনিয়ম আর দুর্নীতির হাট বসেছে। বিশেষ করে বোরো-আমন সংগ্রহের নামে হরিলুট চলে বলে জানান ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদ্য সমাপ্ত বোরো সংগ্রহ নিয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল। কৃষকেরা কাছ থেকে ধান সংগ্রহ ও মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করেছিল সরকার।

সরকার মিলারদের কাছ থেকে আতপ চাল ৩৫ টাকা ও সিদ্ধ চাল কিনেছিল ৩৬ টাকা দরে। তখন চালের বাজারমূল্য আর সরকারি দরের মধ্যে ১০ টাকার বেশি তফাৎ ছিল। চালে বেশি লাভ থাকায় কর্মকর্তারা মিলারদের কাছ থেকে কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা করে টাকা আদায় করেছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব খবর ছাপা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য বিভাগ। বিশেষ করে সিদ্ধচালে বেশি অনিয়ম হয়েছে বলে দাবি মিলারদের। একাধিক মিলার জানান, চট্টগ্রামে সিদ্ধচালের চাহিদা ও মিলার খুবই কম। অন্য জেলা থেকে সংগ্রহ করে খাদ্য বিভাগের কর্মসূচিতে চাল সরবরাহ করা হয়েছিল। সিদ্ধচালে লাভ বেশি থাকায় খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের চাহিদাও বেশি পরিমাণে গুনতে হয়েছে।
দুর্নীতির পুরস্কার : ধান-চাল সংগ্রহে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ২৬ মে রাঙ্গুনিয়া থেকে গুদাম কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ভূঁইয়াকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে কর্মরত রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তিমূলক বদলি হলেও পুরস্কৃত হলেন তিনি। নাজিরহাট খাদ্য গুদামেও একই ধরনের অভিযোগ ছিল। পরবর্তীতে গুদাম কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়।

শুধু আসাদুজ্জামান নন, জেলা খাদ্য বিভাগের গুটিকয়েক কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি সি-িকেট উপজেলা গুদাম ও খাদ্য বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য শস্য ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে সরকারি সহায়তা টিআর, কাবিকা, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিসহ সামাজিক সুরক্ষার চাল-গম সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এই সিন্ডিকেট। সরকারি গুদামে চাল-গম অনিয়মের মাধ্যমে খোলা বাজারে বিক্রির অভিযোগও রয়েছে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এছাড়াও জেলা খাদ্য গুদাম থেকে উপজেলা খাদ্য গুদাম এবং আমদানি করা খাদ্যশস্য দেশের বিভিন্ন গুদামে সরবরাহেও পদে পদে অনিয়ম রয়েছে। খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে খাদ্য বিভাগ।
অভিযোগ ছিল, দালাল ও ফড়িয়াদের মাধ্যমে ধান কেনা হয়েছিল। এতে ধান বিক্রিতে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কৃষক। কৃষকের শ্রম-ঘামে ফলানো ফলন নিয়ে চালবাজি করেছে মিলার ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
১৪ শতাংশের নিচে আর্দ্রতা সম্পন্ন চাল নিচ্ছে খাদ্য বিভাগ। চালের মানের মানদ-ের হিসাবে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের তুষ্ট করতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাদ্য বিভাগ ও গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে উন্নত ও ভালো মানের চাল খোলা বাজারে পাচার হয়ে যায়। টিআর, কাবিখা, এমপিদের বরাদ্দ, শান্তকরণ প্রকল্প (সেনাবাহিনীর প্রকল্প), জেলা পরিষদের ডিও’র বিপরীতে উন্নতমানের চাল খোলা বাজারে পাচার করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে দেওয়ানহাট ও হালিশহর খাদ্যগুদাম থেকে চাল সরবরাহ করা হয়। সরকারি চাল খোলা বাজারে বিক্রি নিয়েও রয়েছে আলাদা সিন্ডিকেট।

একাধিক সূত্র জানায়, পাহাড়তলী বাজারের শাহাবুদ্দিন ও আলমের নেতৃত্বে বড় সিন্ডিকেট রয়েছে চট্টগ্রামে। খাদ্য বিভাগ ও গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সকল ধরনের ডিও’র চাল পাচার করা হয়। মানের জন্য কর্মকর্তাদের কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা করে দিতে হয়। টাকা দিলেই ভালোমানের সরকারি চাল নির্বিঘেœ পাচার হয়ে যায় খোলা বাজারে। আর নি¤œমানের চাল গুদামে পড়ে থাকে। শেষতক মন্ত্রীর নির্দেশনায় ১০টি গুদাম তদন্তের জন্য সিলগালা করা হল।

শুধু চাল নয়, গম নিয়ে চলছে তুঘলকিকা-। চট্টগ্রাম বিভাগের (চট্টগ্রাম মহানগর, তিন পার্বত্য জেলা) গমের চাহিদা কম। মূলত সরকারি গম মিলারদের মাধ্যমে আটা করে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়। কিন্তু আটার কদর কম থাকায় সরকারি গমের সিংগভাগ খোলা বাজারে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ১৪ টাকা ভর্তুকি দরে মিল মালিকদের কাছে গম বিক্রি করে সরকার। অথচ খোলা বাজারে গম বিক্রি হচ্ছে ২৭-২৮ টাকা দরে। সরকারি দরের চেয়ে ১৩-১৪ টাকা তফাৎ রয়েছে। ভর্তুকি দরের কেনা গম খোলা বাজারে বিক্রি করতে পারলে লাভ প্রায় দ্বিগুণ। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিল মালিকেরা ঘুণপোকার মতো গিলে খাচ্ছে ভর্তুতির গম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট