চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চসিকের স্বাস্থ্য সনদ আবার কী!

খাদ্য পরিদর্শক অনুমোদিত পরিদর্শক আছেন মাত্র একজন স্বাস্থ্য সনদ নেয়ার নিয়ম থাকলেও কেউ নেয় না বেশিরভাগ হোটেল-রেস্টুরেন্ট মালিক বিষয়টা কী তাও জানেনও না প্রিমিসেস লাইসেন্স নেই হাজারো খাদ্য বিক্রয়কারি প্রতিষ্ঠানের

ইফতেখারুল ইসলাম

১৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ৩:৩৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর অনুমোদিত পরিদর্শক আছেন মাত্র একজন। তবে অন্য বিভাগ থেকে আরো ১২ জন অস্থায়ীভাবে এই বিভাগে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের আইন প্রয়োগের ক্ষমতা নেই। এ যেন ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। অপরদিকে, নগরীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন খাবারের দোকান। যার সঠিক কোন পরিসংখ্যানও নেই। যে কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

নিরাপদ খাদ্য আইনে ৭৫ রকমের খাদ্যের নমুনা পরীক্ষার কথা বলা আছে। এছাড়া হোটেল রেস্টেুরেন্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফিটনেস পরীক্ষা করে স্বাস্থ্য সনদ নেয়ার নিয়ম থাকলেও কেউ নেয় না। বেশিরভাগ হোটেল-রেস্টুরেন্ট মালিক তা জানেনও না। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর প্রশ্ন স্বাস্থ্য সনদটা আবার কী!

নগরীর বিভিন্ন এলাকার হোটেল মালিক, ফলের দোকানদার, সবজি বিক্রেতাসহ অসংখ্য খাদ্য বিক্রেতার সাথে আলাপকালে জানা যায়, প্রিমিসেস লাইসেন্স নেয়ার বিষয়টি তাদের জানা নেই। হোটেলের বাবুর্চি থেকে শুরু করে সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সনদ নেয়ার বিষয়টিও তারা শুনেননি। যদি সিটি কর্পোরেশনের লোকজন আসে তবে তারা অবশ্যই সহযোগিতা করবেন।
নিরাপদ খাদ্য আইনানুযায়ী হোটেল- রেস্টুরেন্টসহ খাদ্য প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, বিপণনকারী সবাই প্রিমিসেস লাইসেন্সের আওতায় আসবে। প্রতিবছর ৫০০ টাকা ফি দিয়ে চসিক থেকে লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের স্বাস্থ্য সনদ নেয়ার নিয়ম থাকলেও কেউ নেয় না। এই আইন যথাযথভাবে পালন প্রয়োগ করতে পারলে চসিকের বাৎসরিক রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেকখানি হ্রাস পেত।
চসিক সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ সালে প্রিমিসেস লাইসেন্স নিয়েছে ৩২২৩টি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮-১৯ সালে তা আরো কমে হয়েছে ৩০১৪টি। অথচ শহরের একটি ওয়ার্ডের সঠিক তালিকা তৈরি করলেও এর চেয়ে বেশি খাদ্যের দোকান পাওয়া যাবে। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফল, সবজি, জুস, পিঠাসহ নানা ধরনের খাবারের দোকান। চসিকের ১৯৮৮ সালের জনবল কাঠামো অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরিদর্শকের পদ আছে ১১টি। উচ্চমান স্বাস্থ্য পরিদর্শকের পদ দু’টি এবং স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়কের পদ আছে দু’টি। মোট ১৫ পদের মধ্যে ১৩ জনকে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র ইয়াছিনুল হক চৌধুরীর নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা করার ক্ষমতা আছে। বাকিদের সেই ক্ষমতা নেই।

জানতে চাইলে চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী পূর্বকোণকে জানান, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১৯৮৮ সালের নিয়োগ বিধির অনুমোদন না হওয়ার কারণে দীর্ঘ দিন ধরে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান মেয়রের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অবশেষে নিয়োগবিধি অনুমোদন হয়েছে। জনবল নিয়োগের জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য চিঠিও পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে। বর্তমানে ১৩ জন পরিদর্শক অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৮ জনকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ বিষয়ে কোর্স করার জন্য ফৌজদারহাট ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে (আইএইচটি) পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন কোর্স সম্পন্ন করেছে। শহরের সব ধরনের খাবারের দোকান প্রিমেসিস লাইসেন্সের আওতায় এলে সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক কমে যাবে উল্লেখ করে বলেন, লোকবলের অভাবে এই খাতে আশানূরূপ সাফল্য আসছে না। তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি যে জনবল কাঠামো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তাতে প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদের প্রস্তাব করা হয়েছে। যদি প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে নিয়োগ দেয়া যায়, তাহলে কোন খাবারের দোকানই সিটি কর্পোরেশনের নজরদারির বাইরে থাকবে না।

চসিকের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আলী পূর্বকোণকে বলেন, ১৯৮৮ সালের জনবল কাঠামোতে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের কোন পদ নেই। যে কারণে ২০১৩ সালের নিরাপদ খাদ্য আইন প্রতিটি ওয়ার্ডে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। নতুন জনবল কাঠামো বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আছে। এই জনবল কাঠামো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন হয়ে এলে প্রতিটি ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত পরিমাণে লোকবল নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে। ১৯৮৮ সালের জনবল কাঠামো অনুযায়ী খাদ্য পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে তিন বছর মেয়াদি স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ কোর্সের সনদ লাগে। তাই বর্তমানে যারা অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত আছেন তাদেরকে কোর্স করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইনে যেসব খাদ্য পণ্য নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার কথা রয়েছে তার মধ্যে ১. দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য, তরলদুগ্ধ (পাস্তুরিত, নির্জীবকৃত)/তরল বাটার দুগ্ধ, ১.২ ফারমেন্টেড দুগ্ধ/মিষ্টি দধি/সুগন্ধিযুক্ত দুগ্ধ। ১.৩ ঘন দুগ্ধ/বাস্পায়িত দুগ্ধ/টক দধি/মালাই। ১.৪ ক্রিম/আইসক্রিম/আইস-ক্যান্ডি/আইস ললি/কুলফি। ১.৫ গুঁড়া দুগ্ধ/গুঁড়া ঘোল/গুঁড়া ক্রিম/দুগ্ধ জাতীয় বিকল্পসমূহ। ১.৬ পনির/ছানা। ১.৭ দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন/পুডিং। ১.৮ তরল ঘোল/ঘোল জাতীয় খাদ্যদ্রব্য। ২ ভোজ্য তৈল এবং তৈল জাতীয় খাদ্যের মধ্যে রয়েছে ২.১ ভেজিটেবল তৈল/বাটার তৈল/মাছের তৈল/অন্যান্য ভোজ্য তৈল। ২.২ ফ্যাট ইমালশন/বাটার/ঘি/মাখন। ৩ সরবত এবং সরবত জাতীয় পানীয়। ৩.১ চিনি বা গুড়ের সরবত। ৩.২ কৃত্রিম চিনির সরবত। ৩.৩ অন্যান্য সরবত। ৪ ফল এবং শাক-সবজী জাতীয় খাদ্যের মধ্যে ৪.১ তাজা ফল/হিমায়িত ফল। ৪.২ শুষ্ক ফল/অন্যান্য ফলজাত খাবার। ৪.৩ তাজা সবজি/হিমায়িত সবজি/অন্যান্য সবজি-জাত খাবার। ৪.৪ আচার/চাটনি/জেলি। ৫ কনফেকশনারির মধ্যে রয়েছে ৫.১ কোকো পাউডার/চকলেট পাউডার। ৫.২ ক্যান্ডি/নাগেট/চকলেট। ৫.৩ চুইংগাম। ৫.৪ ফুড ডেকোরেশন/টপিংস/সুইট সস। ৬ খাদ্যশস্য এবং শস্য জাতীয় খাদ্যের মধ্যে রয়েছে ৬.১ খাদ্যশস্য ও ডাল (আস্ত বা ভাঙ্গা)। ৬.২ আটা/ময়দা/সুজি/বেসন/সমজাতীয় গুঁড়া দ্রব্য। ৬.৩ ভাত/রুটি। ৬.৪ পাসতা/নুডুল। ৬.৫ রাইস পুডিং/পায়েস। ৬.৬ আবরণী তরল (মৎস্য বা মাংসে ব্যবহৃত)। ৬.৭ চালের পিঠা জাতীয় খাদ্যদ্রব্য। ৬.৮ সয়াবিন কার্ড/সয়া-বেভারেজ/টফু। ৭ বেকারি জাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে ৭.১ ব্রেড/রোলস/বান/মাফিন/পিঠা। ৭.২ কেক/বিস্কিট/পাই/ডোনাট। ৭.৩ ক্রিস্প/চিপস। ৭.৪ কর্ণ ফ্লেক্স/রাইস ফ্লেক্স। ৮ মাংস এবং মাংসজাতীয় খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ৮.১ তাজা মাংস/পোল্ট্রি। ৮.২ প্রক্রিয়াজাত মাংস/পোল্ট্রি। ৮.৩ প্রক্রিয়াজাত কমুটেড মাংস/পোল্ট্রি। ৯ ভক্ষণযোগ্য খাদ্যাবরণের মধ্যে রয়েছে ৯.১ সসেস আবরণ। ১০ মাৎস্য এবং মাৎস্য জাতীয় খাদ্য। ১১ মিষ্টিকারক দ্রব্য। ১১.১ দানাদার চিনি/ফ্রুকটোজ/ডেক্সটোজ/ল্যাকটোজ/সমজাতীয় দ্রব্য। ১১.২ গুড়/মোলাসেস। ১১.৩ সিরাপ/ঘন চিনি/ঘন ফলের রস। ১১.৪ মধু/মল্টজাত পণ্য। ১১.৫ কৃত্রিম মিষ্টিকারক দ্রব্য। ১২ লবণ, মশলা, খাদ্য রং, ইত্যাদি। ১২.১ ভোজ্য লবণ/ফরটিফাইড লবণ/লবণ সাবস্টিটিউট। ১২.২ মশলা। ১২.৩ সিরকা। ১২.৪ খাদ্য রং/খাদ্য রং প্রস্তুতিসমূহ। ১২.৫ বেকিং পাউডার। ১২.৬ সিলভার পাতা। ১৩ ফরমুলেটেড খাবার। ১৩.১ শিশু খাদ্য/ওয়েনিং ফুড। ১৩.২ কমপ্লিমেন্টারি খাবার (বিভিন্ন বয়সের)। ১৩.৩ বিশেষায়িত খাবার (চিকিৎসার কারণে)। ১৩.৪ অন্যান্য ফুড সাপ্লিমেন্টস। ১৪ বেভারেজ (এলকোহলমুক্ত)। ১৪.১ সাধারণ খাবার পানি (প্রাকৃতিক/প্যাকেটজাত)। ১৪.২ ফল/সবজির রস। ১৪.৩ খেজুর/তালের রস। ১৪.৪ কারবোনেটড এনার্জি/নন-এনার্জি বেভারেজ। ১৪.৫ তরল চা/কফি। ১৪.৬ ইনস্ট্যান্ট গুঁড়া চা/কফি। ১৫ রেডি খাবার। ১৬ হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার। ১৭ অনির্ধারিত খাবার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট